চট্টগ্রাম অঞ্চলে লিভার ও পাকস্থলি ক্যানসার রোগী বাড়ছে কেন

দেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে টেকনাফ পর্যন্ত প্রায় চার লাখ ক্যানসার রোগী রয়েছেনছবি: রয়টার্স

বাংলাদেশে চিকিৎসাধীন ক্যানসার রোগী আছেন প্রায় ১৮ লাখ। প্রতিবছর নতুন রোগী শনাক্ত হয় আরও দুই লাখের মতো। দেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম থেকে টেকনাফ পর্যন্ত প্রায় চার লাখ ক্যানসার রোগী রয়েছেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে ১২০ জন ক্যানসার রোগী আসছেন। অন্য হাসপাতালেও নিশ্চয়ই যাচ্ছেন।

আমরা পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে প্রচুর রোগী পাই। দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে সমুদ্রতীরবর্তী অঞ্চলে পাকস্থলীর ক্যানসার রোগী প্রচুর। লিভার ক্যানসারের রোগীর সংখ্যাও বাড়ছে। এই ক্যানসারে চিকিৎসার সুযোগ কম। তাই মৃত্যুর হার বেশি। বেশির ভাগ লিভার ক্যনসার এখানে বি ভাইরাস ও সি ভাইরাস থেকে হয়। তবে বি ভাইরাস সর্বোচ্চ। আজকাল আবার ফ্যাটি লিভার ক্যানসার রোগীও পাওয়া যাচ্ছে। তবে ২০০৫ সাল থেকে দেশে বি ভাইরাস টিকার প্রকল্প চালু হয়েছে। যাঁরা ভ্যাকসিন পাননি অথবা ভ্যাকসিন নেননি, তাঁদেরও এই ভ্যাকসিনের আওতায় আনতে হবে।

অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ
ছবি: প্রথম আলো

রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মধ্যেও লিভার ক্যানসার রোগী পাচ্ছি। ১০ থেকে ১৫ লাখ রোহিঙ্গা যাঁরা ঢুকেছেন, তাঁরা প্রচুর পরিমাণ বি ভাইরাস বহন করেন। সি ভাইরাসও রয়েছে। তাঁরা টিকার আওতায় আসেননি। তাঁরা কিন্তু আমাদের সমাজে মিশে গেছেন। বিষয়টা আমাদের গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। আমরা যত লিভার ক্যানসার রোগী পাচ্ছি, বেশির ভাগ কক্সবাজার ও টেকনাফ অর্থাৎ রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের আশপাশের অঞ্চলের মানুষ।

আরও পড়ুন

কিছু কমবয়সী মানুষ পাচ্ছি, যাঁরা বি ভাইরাসের টিকা না নেওয়ায় লিভার ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। কিছু কোম্পানি এসবের ভালো ওষুধ নিয়ে এসেছে। এটিকে আরও সহজলভ্য করা জরুরি। সরকার বা নীতিনির্ধারকেরা যদি ভ্যাট কমিয়ে বিভিন্ন সুযোগ–সুবিধা দেয়, তাহলে এটা করা সম্ভব। সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষাগুলো সহজলভ্য করা গেলে আরও রোগী পরীক্ষা করাতে উৎসাহিত হবে। আর লিভার ক্যানসারের কিছু চিকিৎসাও এসেছে। যেমন অস্ত্রোপচার, রেডিওফ্রিকোয়েন্সি সেপারেশন, মাইক্রোভাইব্রেশন থেরাপি ইত্যাদি।

চট্টগ্রামের মানুষজন দীর্ঘদিন ধরে পানিতে ভিজিয়ে রাখা সুপারি খায়। এতে আফলাটক্সিন থাকে। এগুলো থেকে পাকস্থলীর ক্যানসার হতে পারে। এ ছাড়া বাসি ভাত, ঝাল–মসলাযুক্ত খাবার, ফরমালিনযুক্ত শুষ্ক মাছের মতো খাদ্যাভাসের জন্য এসব ক্যানসার বেশি হচ্ছে। কমবয়সীদেরও পাকস্থলীর ক্যানসার ধরা পড়ছে। এই ক্যানসার সাধারণত ৬০ বছরের পরে হয়। ৫০ আর ৪০ বছর বয়সের লোকদেরও এখন এটা বেড়ে গেছে যা খুবই শঙ্কাজনক। যাঁরা বিদেশে যাচ্ছেন, তাঁরাও পাকস্থলীর ক্যানসার নিয়ে আসছেন। এটাও খুবই ভীতিকর।

প্রাথমিক পর্যায়েই যদি দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া যায়, তাহলে পাকস্থলী ক্যানসার একদমই ভালো হয়ে যায়। দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে পারলে রোগী ভালো হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ৯০ শতাংশের বেশি।

আরও পড়ুন

পাকস্থলী ক্যানসার থেকে বাঁচতে খাদ্যাভ্যাসও পরিবর্তন করতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মানুষের মেজবান খাওয়া কমাতে হবে, ঝাল খাবার খাওয়া কমাতে হবে, কাঁচা সুপারি খাওয়া কমাতে হবে। ধূমপান কমাতে হবে। আবার এই যে চট্টগ্রামে জাহাজ ভাঙার তেল পানিতে যাচ্ছে, এই পানি থেকে যেসব মাছ আসছে, এগুলো ঠিক আছে কি না, সেটা নিয়েও ভাবতে হবে।

যখন কোনো পরিবারে ক্যানসার রোগী থাকে, তখন সে পরিবার সামাজিক, পারিবারিক ও অর্থনৈতিক চাপের মধ্যে পড়ে। রোগী নিয়ে তারা কোথায় যাবে, বুঝে উঠতে পারে না। কারণ, ক্যানসারের চিকিৎসা বড় হাসপাতাল ছাড়া হয় না। আটটা বিভাগীয় শহরে বিশেষায়িত হাসপাতাল হতে যাচ্ছে। এগুলো খুব জলদি পুরোপুরি কম্প্রিহেনসিভ ক্যানসার সেন্টারের আদলে শুরু করতে হবে। চট্টগ্রামে জরুরি ভিত্তিতে মলিকিউলার ল্যাব স্থাপন করতে হবে। এ ছাড়া বিদেশের মতো বিভিন্ন বিমা, ক্যানসার সাপোর্ট গ্রুপ যদি করা যায়, তাহলে ক্যানসার চিকিৎসায় উন্নতি করা যাবে।

অধ্যাপক ডা. সাজ্জাদ মোহাম্মদ ইউসুফ, বিভাগীয় প্রধান, রেডিওথেরাপি বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।

আরও পড়ুন