স্টেমি হার্ট অ্যাটাকে যা করতে হবে
হার্ট অ্যাটাক আকস্মিক হৃদ্রোগ। দেখা যায়, সুস্থ-সবল মানুষ, হয়তো দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছেন, একদিন হঠাৎ করে হলো হার্ট অ্যাটাক।
বুকের মাঝখানে হঠাৎ ব্যথা হার্ট অ্যাটাকের প্রধান লক্ষণ। কখনো তীব্র ব্যথা, কখনো মনে হয় কেউ যেন বুকটাকে চাপ দিয়ে ধরেছে। বুকের ভেতর প্রচণ্ড ভার অনুভূত হতে পারে। কাঁধ, চোয়াল, বাঁ হাত এমনকি পিঠের দিকেও ছড়িয়ে পড়তে পারে বুকের ব্যথা। এ ধরনের বুকে ব্যথা যখন বিশ্রামেও কমে না, দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হয় অথবা তীব্রতা বাড়তে থাকে, সঙ্গে শরীর ঘামা, বমি অথবা বমিভাব হয়, তখন হার্ট অ্যাটাকের সন্দেহ করা উচিত।
হার্ট অ্যাটাক কখনো প্রাণঘাতী হতে পারে। তাই এ অবস্থায় যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ হাসপাতালে যেতে হবে। দ্রুত হাসপাতালে না নিয়ে যাওয়া ও চিকিৎসার বিলম্বে অনেক হার্ট অ্যাটাকের রোগী পথেই মারা যান। অনেক রোগী হার্ট ফেইলিউর এবং অস্বাভাবিক মাত্রার কম রক্তচাপ বা ‘শক’ নিয়ে এমন সময় হাসপাতালে আসেন, যখন পুরো চিকিৎসা জটিল হয়ে পড়ে।
আমেরিকান কলেজ অব কার্ডিওলজি, আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন, ইউরোপিয়ান সোসাইটি অব কার্ডিওলজিসহ অনেক আন্তর্জাতিক হৃদ্রোগ গবেষণা সংস্থার তৈরি হার্ট অ্যাটাক চিকিৎসার নির্দেশিকা রয়েছে। এসব নির্দেশিকা মতে, হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় কালক্ষেপণ করা যাবে না। প্রতিটি মিনিট এখানে গুরুত্বপূর্ণ। হার্ট অ্যাটাক সন্দেহ, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় সময়ের হিসাব করতে হবে মিনিট কষে।
এখানে ইসিজি খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষা। ইসিজি সুবিধা আছে, নিকটস্থ এমন স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রোগীকে যত দ্রুত নেওয়া যাবে, তত দ্রুত রোগ নির্ণয় করা সম্ভব হবে। বুকে ব্যথার সঙ্গে শুধু ইসিজির পরিবর্তন দেখে ‘স্টেমি’ হার্ট অ্যাটাক (হৃদ্রোগের একটি ধরন) নির্ণয় করা যায়। এ অবস্থায় রোগীকে ওখানেই প্রাথমিক চিকিৎসা এবং হার্টের রক্তনালিতে জমাট রক্ত তরল করার জীবন রক্ষাকারী ওষুধ প্রয়োগ করতে পারলে হার্ট অ্যাটাকজনিত অনেক জটিলতা এড়ানো যায়। হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ স্পষ্ট বোঝা গেলে এবং নিকটস্থ হাসপাতালে পৌঁছাতে বেশি দেরি হলে গন্তব্যপথে তাৎক্ষণিক ৩০০ মিলিগ্রাম অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট এবং ৩০০ মিলিগ্রাম ক্লোপিডোগরেল ট্যাবলেট একসঙ্গে রোগীকে খাওয়ানো যেতে পারে।
রোগী প্রথমে নিকটস্থ যে হাসপাতালে পৌঁছান, তাকে বলে ফার্স্ট মেডিকেল কন্ট্যাক্ট বা প্রথম চিকিৎসা সংযোগ। এখানে ১০ মিনিটের মধ্যেই ইসিজি করে রোগ নির্ণয় করা দরকার। ইসিজিতে ‘স্টেমি’ হার্ট অ্যাটাক হলে রোগীকে সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে চিকিৎসা দিতে হবে। বুকে ব্যথা শুরু হওয়ার কতক্ষণের মধ্যে রোগী সেখানে গেলেন, হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানটি কতটা সক্ষম বা এটি কোন স্তরের হাসপাতাল, সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে রোগীকে জরুরি চিকিৎসার আওতায় আনা হয়।
হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসার সুবিধা সব হাসপাতালে এক রকম থাকে না। তাই রোগীর অবস্থা এবং হাসপাতালের সক্ষমতা অনুযায়ী রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়। তবে প্রথম সংযোগকারী হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এখানে দ্রুত ইসিজি করে ‘স্টেমি’ হার্ট অ্যাটাক নির্ণয়ে বিলম্ব করা যাবে না। কখনো হার্ট অ্যাটাকের প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে রোগীকে উচ্চতর লেভেলের হাসপাতালে প্রেরণ করার দরকার পড়ে। কারণ, বুকে ব্যথা শুরুর ১২ ঘণ্টার মধ্যে হাসপাতালের সক্ষমতা এবং রোগীর অবস্থা সমন্বিত হলে রোগীকে তাৎক্ষণিক রিং বা স্টেন্ট লাগিয়েও চিকিৎসা করা হয়। ১২ ঘণ্টার মধ্যে রিং বা স্টেন্ট লাগিয়ে চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রথম সংযোগকারী হাসপাতাল থেকে এ রকম সুবিধা–সংবলিত হাসপাতালে পৌঁছানোর সময়-ব্যবধান ইসিজিতে হার্ট অ্যাটাক নির্ণয়ের সময় থেকে দুই ঘণ্টার কম হতে হবে। এত কম সময়ের ব্যবধানে সে রকম সুযোগ–সংবলিত হাসপাতালে পৌঁছে রিং লাগিয়ে চিকিৎসা করার সুযোগ আমাদের দেশে এখনো সীমিত। রিং লাগিয়ে চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল। হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা নির্দেশিকাগুলো এসব দিক বিবেচনা করেছে। তারা বলছে, ইসিজিতে ‘স্টেমি’ হার্ট অ্যাটাক নির্ণয় থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে যদি রোগীকে তাৎক্ষণিক রিং লাগানোর সুবিধা–সংবলিত হাসপাতালে প্রেরণ করা না যায়, তাহলে বুকে ব্যথা শুরুর ১২ ঘণ্টার মধ্যে রোগীর হার্টের রক্তনালিতে জমাট বাঁধা রক্ত তরল করার বিশেষ ওষুধ ব্যবহারের সুযোগ থাকে। বহুল ব্যবহৃত এ ধরনের দুটি ওষুধ হলো, স্ট্রেপটোকাইনেজ ও টেনেকটাপেলেজ। সে ক্ষেত্রে উচ্চতর হাসপাতালে প্রেরণের আগে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে (সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ আধা ঘণ্টা) প্রাথমিক চিকিৎসার (৩০০ মিলিগ্রাম অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট, ৩০০ মিলিগ্রাম ক্লোপিডোগরেল ট্যাবলেট এবং ৮০ মিলিগ্রাম এটোর-ভাস্টাটিন) পাশাপাশি স্ট্রেপটোকাইনেজ অথবা টেনেকটাপেলেজ ইনজেকশন দেওয়া শেষ করতে হবে এবং রোগীকে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য স্টেন্ট বা রিং লাগানোর সুবিধা–সংবলিত হাসপাতালে প্রেরণ করতে হবে।
কিছু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকলেও স্ট্রেপটোকাইনেজ অথবা টেনেকটাপেলেজ ইনজেকশন ‘স্টেমি’ হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় খুব কার্যকর। আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে রোগীর স্বজনের সঙ্গে সব দিক অবহিত করে এ ওষুধ প্রথম সংযোগকারী হাসপাতালে ব্যবহার করতে বাধা নেই। বরং কোনো কারণে হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা বিলম্ব হলে জটিলতার দিকে যেতে পারে অসুখ। তাতে একদিকে রোগীর চিকিৎসা জটিল হয়ে পড়ে; অন্যদিকে ক্রমাগত ঝুঁকির সম্মুখীন হতে থাকেন রোগী।
অধ্যাপক ডা. মো. আফজালুর রহমান: সাবেক পরিচালক ও অধ্যাপক, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা