‘পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব করে মরে যেতে ইচ্ছে করত’
আজ বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। দ্য ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন অব মেন্টাল হেলথ ২০২৩ সালে দিবসটির প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে ‘মানসিক স্বাস্থ্য বিশ্বজনীন মানবাধিকার’। মানসিক চাপের ভেতর পড়তে পারেন যে কেউ। সেটা কাটিয়ে উঠতে পারাটাই জরুরি। কীভাবে নিজের বিষণ্নতা কাটিয়ে উঠলেন, সেই গল্পই শুনিয়েছেন সৌমেন্দ্র গোস্বামী
ছোট থেকেই ডাক্তারি পড়ার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু এসএসসিতে জিপিএ–৪.৯৪ পেয়ে হতাশ হয়ে পড়ি। শিক্ষকদের কাছে পরামর্শের জন্য গেলে অনুপ্রাণিত করে বলেন, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় এসএসসি ও এইচএসসির জিপিএর ওপর ১০০ নম্বর পেতে হবে। এইচএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার চেষ্টা করো। স্বপ্ন পূরণ করতে পারবে। এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে নিশ্চিত ছিলাম, জিপিএ-৫ পাব। কিন্তু এইচএসসিতেও সামান্যর জন্য জিপিএ-৫ মিস করি। তবে প্রস্তুতি ভালো ছিল। ভেবেছিলাম, জিপিএর নম্বরের ঘাটতি পরীক্ষায় পুষিয়ে নেব। কিন্তু মেডিকেল ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। সেবারই (২০১৬-১৭ সেশনে) জিপিএর নম্বর ১০০ থেকে ২০০–তে উন্নীত করা হয়। ফলে ঘাটতি থাকা নম্বরও দ্বিগুণ হয়ে যায়। পরীক্ষাতেও বিপত্তি ঘটে। মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষা এমসিকিউ ফরমেটে হয়। সিরিয়াল নম্বর ভুল করে একটার উত্তর অন্যটাতে...এভাবে বারোটা এমসিকিউ ভুল করায় ১০০ নম্বরে ৬২.৭৫ পাই। চূড়ান্ত মেধা তালিকা জিপিএর নম্বর ও পরীক্ষার নম্বর যোগ করে করা হয়। যে কারণে মেরিটে অনেক পিছিয়ে যাই।
দ্বিতীয়বারও চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সেবারও নিয়মের জালে আটকে যাই। প্রথমবারের মতো মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় দ্বিতীয়বার অংশগ্রহণকারীদের ৫ নম্বর কেটে মেধাতালিকা করার নিয়ম চালু হয়। হতাশ হয়ে হাল ছেড়ে দিই।
প্রস্তুতি না থাকায় প্রথমবার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা না দিলেও বাবার জোরাজুরিতে দ্বিতীয়বার দুই-তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দিই। কোনোটাতেই কিছু হয়নি। বাবা বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তির জন্যও জোর করেছিলেন। কিন্তু সব দিক বিবেচনা করে রাজি হতে পারিনি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরম ওঠানো ছিল। সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজে রসায়নে অনার্স পড়তে শুরু করি।
তখন আমি একেবারে এলোমেলো। কোনো কিছুতে মন বসে না। লক্ষ্যহীন, স্বপ্নহীন জীবন। নিজেকে মনে হয় পৃথিবীর সবচেয়ে দুঃখী মানুষ। পাওয়া-না পাওয়ার হিসাব করে মরে যেতে ইচ্ছে হতো। কারও সঙ্গে মিশতে পারি না। পরিচিত, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন কম-বেশি সবাই টিপ্পনী কাটেন। আশপাশের অনেকেই চান্স পেয়েছে। মা–বাবা উচ্চারণ করে কিছু না বললেও মনে মনে কষ্ট পান, আরও বেশি ব্যথিত হই। এর মধ্যে একজন শুভাকাঙ্ক্ষী কথায় কথায় আমাকে বলেন, ‘গোলাপ ফুল যেখানেই থাকুক, তার কাজ কিন্তু সুবাস ছড়ানো।’ তাঁর কথায় অনুপ্রাণিত হয়ে, না অন্য কোনো কারণে জানি না, নিজেকে বাঁচাতে কাজ শুরু করি। প্রথম পদক্ষেপে মনে আসা সমস্ত ভাবনা ডায়েরিতে লিখতে থাকি। কিন্তু আগের দিনের লেখা পরের দিন পড়ি না। সঙ্গে সঙ্গে যাঁদের কথা ব্যথিত করত, তাঁদের সংস্পর্শে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। সময় কাটাতে গল্প, কবিতা, উপন্যাস পড়তে আরম্ভ করি। টিউশনির কাজেও যুক্ত হই। কিছুদিন যেতে একটা গিটার কিনি। কলেজজীবনে গান শিখেছিলাম। চর্চাটা আবারও শুরু করি। আবৃত্তির সঙ্গেও যুক্ত হই। ২০২০ সালে বাবা দিবসে প্রথম আলোর ‘বাবা, তোমাকে বলা হয়নি’ আয়োজনে গল্প লিখে পাঠাই। সেরা দশ গল্পকারের একজন হিসেবে পুরস্কার পাই। অনুপ্রাণিত হয়ে লেখালেখির চর্চাও শুরু করি। ধীরে ধীরে খারাপ লাগা, হতাশা কমতে থাকে। নিজেকে আরও ব্যস্ত রাখতে সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। প্রথম আলো বন্ধুসভা, যশোরে যোগ দিই।
আজ প্রায় পাঁচ বছর পর এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে আমি ভালো আছি, বেশ ভালো আছি। লোকে কী বলল, বলবে—এসব আমাকে আর ভাবায় না। কারও সঙ্গে নিজেকে তুলনা করি না। কারণ, আমি বিশ্বাস করি, প্রত্যেক মানুষ চেহারায় যেমন আলাদা, প্রত্যেকের সফলতার ধরনও আলাদা। জীবনের প্রতিটা দিন কোনো না কোনো লড়াইয়ের। টাকা-পয়সা সাময়িক সহযোগিতা করলেও সব লড়াইয়ে বিজয়ী করতে পারে না। একইভাবে জীবনে উদ্ভূত প্রতিটি প্রশ্ন, প্রতিটি সমস্যা, প্রতিটি ব্যর্থতাও আপেক্ষিক। যেমন আজ আর কেউ আমার কাছে পরীক্ষার ফলাফল কিংবা কোন বিষয়ে, কোথায় পড়েছি জিজ্ঞেস করেন না। অধিকাংশের মুখে এখন একটাই প্রশ্ন, ‘কী করছ?’
জানি, সামনের পথটা আরও বন্ধুর, আরও বেশি প্রতিযোগিতায় ভরা। কিন্তু যেহেতু মনকে, ভাবনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছি, তাই নিশ্চয়ই জীবনের সমস্ত বিপর্যয়কে সয়ে নিতে পারব। তা ছাড়া আমি তো একা নই। হতাশা থেকে বাঁচতে শুরু করা প্রতিটি কাজ—লেখালেখি, গান, আবৃত্তি আমার শক্তিতে পরিণত হয়েছে। শীর্ষস্থানীয় বেশ কয়েকটি পত্রিকা ও ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখা ছাপা হচ্ছে। এরও বেশি আনন্দের, এই সব কিছুকে সঙ্গে নিয়েই একটি লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছি। হতাশা আমাকে এখন আর ছুঁতে পারে না।