গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়ার মতো এমন আকস্মিক মৃত্যু কেন হয়? কীভাবে ঠেকানো সম্ভব
বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনে চলছিল জাতীয় দাবা প্রতিযোগিতা। ৫ জুলাই খেলতে খেলতেই মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়লেন গ্র্যান্ডমাস্টার জিয়াউর রহমান। তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫০ বছর। এই বয়সে রোগে ভোগে অনেকের মৃত্যু হয়। কিন্তু এমন আকস্মিক মৃত্যু, যা কোনো কিছু জানান না দিয়েই আচমকা আসে, তা কেন হয়? চিকিৎসা বিজ্ঞান কী বলে?
সাডেন ডেথ বা আকস্মিক মৃত্যুর বেশির ভাগই হৃদ্যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত। বিজ্ঞানীরা বলেন, এ ধরনের আকস্মিক মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ পাঁচটি। আসুন সেসব সম্পর্কে জেনে নিই।
১. অ্যারিদমিয়া বা হৃৎস্পন্দনের অনিয়ম: হৃৎস্পন্দন হঠাৎ করেই এলোমেলো হওয়ার কারণে কারও আকস্মিক মৃত্যু হতে পারে। বিশেষ করে ভেন্ট্রিকুলার অ্যারিদমিয়া বা ভেন্ট্রিকুলার ফিব্রিলেশন আকস্মিক মৃত্যুর অন্যতম কারণ। কোনো জানান না দিয়েই হতে পারে এই সমস্যা। আবার আগে থেকে যাঁদের হার্টের সমস্যা আছে, বা হার্ট অ্যাটাক হওয়ার পরপর, রক্তে ইলেকট্রোলাইটের আকস্মিক ভারসাম্যহীনতা, কোনো ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় হতে পারে এমন। সঙ্গে সঙ্গে ইসিজি মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সমস্যা শনাক্ত করে দ্রুত ডিফিব্রিলেটর যন্ত্র দিয়ে চিকিৎসা করা হলে কখনো মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব।
২. অ্যাকিউট মাইয়োকার্ডিয়াল ইনফারকশন বা আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক: আগে থেকে কোনো জানান না দিয়ে হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হতে পারে যে কারও, বিশেষ করে চল্লিশের পর। হার্ট অ্যাটাকের কারণ হৃদ্যন্ত্রের রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালিতে চর্বির আস্তরণ পড়ে ব্লক হওয়া। অনেকেরই এই ব্লকের কোনো উপসর্গ আগে নাও থাকতে পারে। ডায়াবেটিস রোগীদের উপসর্গ না হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। আকস্মিক বুকে চাপ, ঘাম, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি হতে পারে এ সময়। যাঁদের বয়স চল্লিশের বেশি, ধূমপায়ী, ডায়াবেটিস বা উচ্চ রক্তচাপ আছে, পরিবারে হার্ট অ্যাটাকের ইতিহাস আছে, ওজন বেশি ও রক্তে কোলেস্টেরল বেশি, তাদের এমন আকস্মিক হার্ট অ্যাটাক হওয়ার ঝুঁকি বেশি। ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাক বা কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হয়ে গেলে অনেক সময় হাসপাতালে নেওয়ার সময়টুকুও মেলে না।
৩. ইনট্রাক্রেনিয়াল হেমোরেজ বা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ: হঠাৎ মস্তিষ্কের কোনো রক্তনালি ছিঁড়ে গিয়ে রক্তক্ষরণ হয়ে বা হেমোরেজিক স্ট্রোক হয়ে আকস্মিক মৃত্যু হতে পারে। উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের এটা বেশি হয়। এ ছাড়া কম বয়সে জন্মগত রক্তনালির ত্রুটির কারণেও হতে পারে। প্রচণ্ড মাথাব্যথা, মুখ বা শরীরের কোনো এক দিক অবশ হয়ে আসা, কথা জড়িয়ে যাওয়া, রক্তচাপ অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়া, অচেতন হয়ে পড়া এর লক্ষণ। রক্তক্ষরণ বেশি হয়ে যদি মস্তিষ্ককে চাপ দেয় এবং অক্সিজেন সরবরাহ কমিয়ে দেয়, তবে চিকিৎসা নেওয়ার সময় না–ও মিলতে পারে।
৪. পালমোনারি এমবলিজম: ফুসফুসে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালিতে হঠাৎ রক্ত জমাট বাঁধাকে বলে পালমোনারি এমবলিজম। সাধারণত বয়স্ক ব্যক্তিদের, বিশেষ করে কোনো বড় অস্ত্রোপচারের পর, দীর্ঘমেয়াদি অসুস্থতার কারণে শয্যাশায়ী থাকলে, পায়ে ডিপ ভেইন থ্রম্বোসিস থাকলে এমন হতে পারে। অনেক সময় সন্তান প্রসবের পর এ কারণে প্রসূতির আকস্মিক মৃত্যু হতে শোনা যায়।
৫. অ্যাওরটা বা মহাধমনিতে সমস্যা: শরীরের মহাধমনি বা অ্যাওরটাতে আকস্মিক ডিসেকশন বা অ্যানিউরিজম আকস্মিক মৃত্যুর একটি কারণ। রক্তনালির জন্মগত ত্রুটির কারণে বা ভাসকুলার কোনো সমস্যার কারণে এমনটা হতে পারে। ধূমপান, দীর্ঘদিন অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপও এর কারণ। হঠাৎ করে মধ্য পেটে প্রচণ্ড ব্যথা তীরের মতো পেছন পর্যন্ত বিঁধিয়ে যাওয়া এর প্রধান লক্ষণ।
কীভাবে ঠেকানো সম্ভব
সাডেন ডেথ বা আকস্মিক মৃত্যুর এই কারণগুলোয় সময় খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রতিটি সেকেন্ড এখানে মহামূল্যবান। তৎক্ষণাৎ কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন বা জীবন রক্ষাকারী পদক্ষেপ নিতে পারলে মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই হাসপাতালে পৌঁছানোর মতো পর্যাপ্ত সময় মেলে না। আশপাশের সাধারণ মানুষ, শিক্ষার্থী, প্যারামেডিক, পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিসের সেবাদানকারীদের মধ্যে সিপিআর প্রশিক্ষণ বা বেসিক লাইফ সাপোর্টের যথাযথ প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। দরকার জরুরি সেবা নম্বরে কল করে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্স ডাকা যাতে সিপিআর বা ডিফিব্রিলেশনের সুব্যবস্থা আছে।
বেশির ভাগ সাডেন ডেথই হৃদ্যন্ত্রের সুস্থতার সঙ্গে জড়িত। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ধরনের মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়তে থাকে। সুশৃঙ্খল জীবনযাপন, নিয়মিত ব্যায়াম ও কায়িক শ্রম, ওজন নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান বর্জন, রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, রক্তে মন্দ চর্বি নিয়ন্ত্রণ করার মাধ্যমে আপনি এই ঝুঁকি কমাতে পারেন।
ডা. তানজিনা হোসেন: সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি ও মেটাবলিজম বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ