ডেঙ্গু চরিত্র পাল্টাচ্ছে
দিন দিন খারাপ হচ্ছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি। বাড়ছে সংক্রমণের হার, তীব্রতা আর জটিলতা। হাসপাতালের শয্যা, চিকিৎসক ও নার্সের অপ্রতুলতার কারণে ডেঙ্গুর চিকিৎসা দিতে গিয়ে ব্যাহত হচ্ছে অন্যান্য রোগের চিকিৎসা। তাই ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বাড়াতে হবে সচেতনতা, নিতে হবে বড় ধরনের জাতীয় পরিকল্পনা
১৯৬০ সালেও একবার ঢাকায় ডেঙ্গু জ্বরের প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। তখন এর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ঢাকা ফিভার’। তবে ডেঙ্গুর প্রথম বড় ধরনের সংক্রমণ দেখা দেয় ২০০০ সালে। এর পর থেকে প্রায় প্রতিবছরই বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে এই রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা যাচ্ছে। ২০০৭, ২০০৯, ২০১৯ সালে ডেঙ্গু বেশ ভয়ংকর রূপে দেখা দিয়েছিল। এমনকি কোভিড মহামারির মধ্যেও থেমে থাকেনি ডেঙ্গুর আক্রমণ। আর এ বছর, মানে ২০২৩ সালে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে ডেঙ্গু জ্বর।
ডেঙ্গু ভাইরাসজনিত রোগ। এডিস ইজিপ্টি নামের মশার মাধ্যমে ছড়ায় এই ভাইরাস। ডেঙ্গু ভাইরাসের মোট চারটি উপধরন রয়েছে। এগুলো হলো ডেন১, ডেন২, ডেন৩ ও ডেন৪। এর যেকোনো একটি দিয়ে সংক্রমিত হলে পরবর্তী সময়ে অন্য উপধরন দিয়ে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। মানে, একবার ডেঙ্গু হলেও বারবার ডেঙ্গু হতে পারে; বরং দ্বিতীয়, তৃতীয় বা চতুর্থবারের সংক্রমণে জটিলতার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
এত দিন দেখা যাচ্ছিল, ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বর মৃদু ধরনের হয়ে থাকে। অনেক সময় সাধারণ জ্বরের মতোই প্রায় উপসর্গহীন থাকে। কিন্তু দিন দিন ডেঙ্গু জ্বরের তীব্রতা বাড়ছে। জিনগতভাবে নিজেকে পরিবর্তন করে বছর বছর নতুন নতুন রূপে আবির্ভূত হচ্ছে ডেঙ্গু ভাইরাস। ডেঙ্গুর চিরাচরিত উপসর্গ (উচ্চ মাত্রার জ্বর, সঙ্গে প্রচণ্ড মাথা ও শরীরব্যথা, চতুর্থ বা পঞ্চম দিনে ফুসকুড়ি) এখন আর তেমন হচ্ছে না। কারও কারও ক্ষেত্রে স্বল্পমাত্রার জ্বর, পরদিনই ফুসকুড়ি দেখা যাচ্ছে বা দু–এক দিনের মধ্যেই প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে বা জটিল হয়ে পড়ছে।
একই সঙ্গে এডিস মশার চরিত্রও পরিবর্তিত হচ্ছে। আগে ধারণা করা হতো, এই মশা কেবল দিনের বেলা, ভোরে ও সন্ধ্যায় কামড়ায়; পরিষ্কার জমা পানিতে জন্মায়। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, রাতেও এডিস মশা কামড়াচ্ছে এবং বদ্ধ নোংরা ড্রেনের পানিতেও লার্ভা মিলছে। যত দিন যাবে, এই পরিবর্তনের প্রবণতা আরও বাড়বে।
ডেঙ্গু জ্বরের উপসর্গ
ডেঙ্গুর প্রধান উপসর্গ জ্বর। সাধারণত জ্বর তীব্র মাত্রার হয়ে থাকে, ১০৪ থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট অবধি উঠতে পারে। জ্বরের সঙ্গে থাকে তীব্র মাথাব্যথা, চোখব্যথা, সারা শরীরে ব্যথা; যার জন্য এর আরেক নাম ব্রেক বোন ফিভার। তিন–চার দিন পর সারা গায়ে র৵াশ বা লালচে দানা দেখা দিতে পারে। জ্বর সাধারণত চার–পাঁচ দিন পর এমনিতেই সেরে যায়। সংকট তখনই শুরু হয়। এ সময় রক্তনালিগুলো থেকে তরল বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে, রক্তচাপ কমে যেতে পারে, পেটে বা ফুসফুসে পানি জমতে পারে। একই সঙ্গে কমে যেতে পারে প্লাটিলেট বা অণুচক্রিকা, যার কারণে অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ হতে পারে। একে তখন বলে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার। এই পরিস্থিতিও বেশির ভাগ রোগী সামলে উঠতে পারেন, তবে কারও কারও এরপর আরও জটিলতা সৃষ্টি হতে পারে, যাকে বলে ডেঙ্গু শক সিনড্রোম।
যেসব উপসর্গকে বিপদচিহ্ন বলে ধরা হয় বা লাল সংকেত বলা হয়, সেগুলো হলো—
তীব্র পেটব্যথা
প্রচণ্ড বমি
শ্বাসকষ্ট
রক্তপাত (মাড়ি, মল ইত্যাদি)
অস্থিরতা ও নিস্তেজ ভাব
হাত–পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া, রক্তচাপ কমে যাওয়া
এসব উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক কোনো জটিল রোগ (যেমন অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস, কিডনি রোগ, হৃদ্রোগ ইত্যাদি) থাকলে এবং অন্তঃসত্ত্বা নারীদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে।
ডেঙ্গু হলে কী করবেন
প্রথম কথা হলো, দ্রুত রোগ শনাক্ত করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পর্যবেক্ষণ বলছে, দেরিতে টেস্ট এবং দেরি করে হাসপাতালে আসাই ডেঙ্গুতে মৃত্যুর প্রধান ঝুঁকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। যেহেতু এটা ডেঙ্গুর মৌসুম, তাই জ্বর হলেই ডেঙ্গু পরীক্ষা করতে হবে। আগেই বলেছি, ডেঙ্গু ভাইরাস তার প্রকৃতি পাল্টেছে। তাই ক্ল্যাসিক্যাল বা চিরাচরিত উপসর্গ না–ও থাকতে পারে। ফলে কালক্ষেপণের কোনো সুযোগ নেই। এই মৌসুমে জ্বর হলেই প্রথম দিনই ডেঙ্গু এনএস১ অ্যান্টিজেন করে ফেলুন। এটা সাধারণত প্রথম তিন দিনের মধ্যেই করা ভালো। সময় পেরিয়ে গেলে ডেঙ্গু অ্যান্টিবডি টেস্ট করতে হবে। তার সঙ্গে করতে হবে রক্তের সিবিসি, হিমাটোক্রিট ও এসজিপিটি।
ডেঙ্গু পজিটিভ হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। সব সময় হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে, তা নয়। বাড়িতে বিশ্রাম, প্রচুর পানি ও তরল পান এবং জ্বর বা ব্যথা কমাতে প্যারাসিটামল সেবন—বেশির ভাগ রোগীর ক্ষেত্রে এগুলোই যথেষ্ট। তবে রোগীকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণের মধ্যে রাখুন। ওপরে যে বিপদচিহ্নগুলোর কথা বলা হলো, সেগুলোর কোনো একটি দেখা দিলে দ্রুত হাসপাতালে নিন।
বাড়িতে আরেকটি কাজ করতে হবে, তা হলো রোগীকে আলাদা করে ফেলা। একটি আলাদা ঘরে মশারির ভেতরে রোগীকে রাখতে পারলে ভালো। কারণ, তাঁকে যে মশা কামড়াবে, সেই মশা বাড়ির অন্য সদস্যদের কামড়ালে তাঁদেরও ডেঙ্গু হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তবে মনে রাখবেন, ডেঙ্গু ছোঁয়াচে নয়। এক টয়লেট ব্যবহার, একসঙ্গে খাদ্য গ্রহণ করলে ডেঙ্গু হবে না। এমনকি ডেঙ্গু রোগী শিশুকে বুকের দুধও পান করাতে পারবেন।
পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। প্রচুর তরল পান করতে হবে। আরেকটি কথা, ডেঙ্গু রোগী সম্পূর্ণ সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে।
শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে নিতে দেরি করা যাবে না।
চাই সচেতনতা
ডেঙ্গু প্রতিরোধে সরকার ও সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব যেমন আছে, তেমনি প্রত্যেক নাগরিকেরও কিছু করণীয় আছে। নিজ বাড়ি ও তার আশপাশ পরিচ্ছন্ন রাখা প্রত্যেকের কর্তব্য। বাড়িতে টবের নিচে, ছাদে, এসির নিচে, বাগানে বা গ্যারেজে পানি জমে আছে কি না, নিয়মিত লক্ষ রাখতে হবে। পাড়ায় পাড়ায় কমিটি তৈরি করে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেষ্ট হতে হবে। এডিস মশার জন্ম যেহেতু ঘরেই, তাই ঘর থেকেই শুরু করতে হবে প্রতিরোধ কার্যক্রম।
মশা ও লার্ভা নিধন ছাড়া ডেঙ্গু মোকাবিলার আর কোনো সফল পন্থা এখন পর্যন্ত নেই। এর বাইরে এই মৌসুমে নিজেদের, বিশেষ করে শিশুদের সুরক্ষার জন্য কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। যেমন ফুলহাতা জামা বা প্যান্ট পরা, দিন বা রাতে ঘুমের সময় মশারি ব্যবহার, মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার, দরজা–জানালায় নেট ব্যবহার ইত্যাদি।
ডেঙ্গুর টিকা নিয়ে গবেষণা চলছে। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে আমরা ডেঙ্গুর টিকা পেয়ে যাব। তত দিন পর্যন্ত ব্যাপক জনসচেতনতা ছাড়া আর কিছু করার নেই।