শিশু কেন ঘুমায় না
শিশুর শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধির জন্য পর্যাপ্ত ঘুম দরকার। কিন্তু অনেক শিশু ঘুমের সমস্যায় ভুগে থাকে। এই শিশুরা স্কুলে অমনোযোগী থাকে, দিনে ঝিমঝিম ভাব থাকে, পরীক্ষায় ভালো ফল করতে পারে না, মেজাজ খিটখিটে হয়, দীর্ঘমেয়াদি মাথাব্যথা ও স্থূলতায় ভুগে থাকে।
মানুষের ঘুমের পরিমাণ ও তীব্রতা নির্ধারণে ‘প্রসেস-এস’ এবং অ্যাডিনোসিন ও অন্যান্য রাসায়নিক পদার্থের প্রভাব থাকে। ঘুমসংক্রান্ত রাসায়নিক পদার্থগুলোকে বলে সমনোজেন। শিশু বয়সে এসব সমনোজেন থাকে বাড়তি মাত্রায়, ফলে এ বয়সের শিশু দিনে বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারে না। দিনের বেলার ঘুমে (ন্যাপস) ঢলে পড়ে।
মস্তিষ্কের ‘প্রসেস-সি’ ২৪ ঘণ্টাব্যাপী ঘুমানোর সময়কাল, ঘুম-জাগরণের ঢেউ নিয়ন্ত্রণ করে। এর মাস্টার ঘড়িটা মগজের হাইপোথ্যালামাস অংশে অবস্থিত। রক্তসরবরাহ তন্ত্র, হরমোন, কিডনি ও ফুসফুসে ছড়িয়ে থাকা ঘুমঘড়ির ছোট ছোট বার্তাবাহকগুলো এই অংশের নিয়ন্ত্রণে। ঘুমের ‘সারকাডিয়ান ছন্দের’ কাজে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
বয়সভেদে শিশুর ঘুম ও ঘুমের সমস্যা
নবজাতক ও প্রথম দুই মাস বয়স: এই বয়সের শিশু ২৪ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ১০-১৯ ঘণ্টা ঘুমিয়ে কাটায় (গড়ে ১৩ থেকে সাড়ে ১৪ ঘণ্টা), যা প্রিম্যাচিউর বা সময়ের আগেই জন্মানো শিশু হলে আরও বেশি। প্রথম সপ্তাহে রাত-দিনে ঘুমানোর কোনো শিডিউল গড়ে ওঠে না। পরের দিকে রাতে সাড়ে আট ঘণ্টা ও দিনে পৌনে ছয় ঘণ্টার মতো ঘুমের পরিমাণ নির্দিষ্ট হয়। বুকের দুধ খেয়ে তৃপ্ত থাকলে নবজাতক কখনো চার থেকে পাঁচ ঘণ্টাও একনাগাড়ে ঘুমাতে পারে। শূলবেদনা, অ্যাপনিয়া (হঠাৎ হঠাৎ শ্বাসপ্রশ্বাসের অসুবিধা), রিফ্লাক্স, ফর্মুলা খাবারে অ্যালার্জি ইত্যাদি কারণে এ বয়সের শিশুদের ঘুমের সমস্যা হতে পারে।
২ থেকে ১২ মাস বয়সী (ইনফ্যান্ট) শিশু: গড়ে এ বয়সের শিশু ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা অবধি ঘুমিয়ে কাটায়। মাথা দোলানো, পা ঝাঁকানো (রিদমিক মুভমেন্ট ডিজঅর্ডার), অনেক রাত অবধি ঘুম থেকে উঠিয়ে শিশুকে খাওয়ানোর অভ্যাস, ক্ষুধা, প্রস্রাব–পায়খানায় ভিজে যাওয়া, ঠান্ডা আবহাওয়া, একা রেখে মা কোথাও চলে যাবে এই বিচ্ছেদভীতি এ বয়সের শিশুর ঘুমের ব্যাঘাতের কারণ।
১ থেকে ৩ বছর বয়সী (টোডলারস): দিবানিদ্রাসহ শিশুর দৈনিক ঘুমের পরিমাণ ১১ থেকে ১৪ ঘণ্টার মতো। প্রধান ঘুমের সমস্যা হলো—ঘুম আতঙ্ক। এ বয়স থেকে শিশুকে নির্দিষ্ট সময়ে শোয়াতে নিয়ে যাওয়ার রুটিন গড়ে তোলা উচিত।
স্কুলে যাওয়ার আগের বয়সে (৩-৫ বছর): দিবানিদ্রাসহ দৈনিক ঘুমের পরিমাণ ১০-১৩ ঘণ্টা। ৪ বছর বয়সের ২৬ শতাংশ শিশু ও ৫ বছর বয়সে মাত্র ১৫ শতাংশ শিশু দিবানিদ্রায় যায়। এ বয়সের শিশুর প্রধান ঘুমের সমস্যার মধ্যে আছে—স্লিপ ওয়াকিং, ঘুম আতঙ্ক ও হঠাৎ শ্বাসরোধ হওয়ার মতো পরিস্থিতি। এ বয়সে থেকে যাওয়া ঘুমের সমস্যা ক্রনিক হয়ে যেতে পারে, যা থেকে সে প্রস্রাব করে বিছানাও ভেজায়।
মধ্য শৈশব (৬-১২ বছর): দৈনিক মোট ঘুম ৯ থেকে ১২ ঘণ্টা। বিদ্যালয়ের পরিবেশ ও আচরণের সমস্যা, পর্দার ব্যবহার, যেমন টেলিভিশন, কম্পিউটার, ভিডিও গেম, ইন্টারনেট আসক্তি ঘুমে ব্যাঘাত ঘটায়। যা ঘুম আতঙ্ক, কম ঘুম ও ঘুমে শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হওয়ার মতো জটিলতা তৈরি করতে পারে।
বয়ঃসন্ধিকাল: এ বয়সে শিশুর দৈনিক কমপক্ষে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত। দেরি করে ঘুমানো, ক্লাস থাকার সময়ে ও ছুটির দিনের ঘুম রুটিনে বড় তফাত থাকা অনুচিত। চারপাশে নানা প্রতিযোগিতার দুশ্চিন্তা তার ঘুমকে প্রভাবিত করে। ফলে স্বাভাবিক নিদ্রা হয় না, সে নারকোলেপসিতে ভোগে। কেউ কেউ ঘুমে ক্রমাগত পা ঝাঁকায়। এই ঘুমহীন অবস্থা নানা সংকট তৈরি করে। যেমন স্কুলে সমস্যা সৃষ্টি, পারফরম্যান্সে ভাটা, মনোযোগ কমে যাওয়া ও স্বল্পকালীন দুর্বল স্মৃতিশক্তি। শিশু তাৎক্ষণিকভাবে কোনো কিছুর উত্তর দিতে পারে না, মেজাজ থাকে চড়া। বাইসাইকেল বা গাড়ি চালাতে প্রায় দুর্ঘটনার শিকার হয়।
শিশুর স্বাস্থ্যকর ঘুম ও ঘুম সমস্যার প্রতিকার
শিশুর সুস্বাস্থ্যের জন্য ঘুম ভীষণ প্রয়োজনীয় উপাদান। গবেষণা বলছে, অনধিক ৫ বছরের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন শিশুর ঘুমের সমস্যা থাকে। এদের মধ্যে আবার ৩০ শতাংশের এ সমস্যা বেশ প্রকট। তবে শিশু যত বড় হতে থাকে, সমস্যা তত হ্রাস পায় এবং ৮ বছর বয়সে এসে প্রতি ১০ জন শিশুর একজন মাত্র ঘুমের অসুবিধায় ভোগে।
শিশুর ৪ বছর বয়স থেকে ১৮ বছর বয়স অবধি প্রয়োজনীয় ঘুমের সবটুকুই রাতে বরাদ্দ। তখন থেকে আর দিনের ঘুমের প্রয়োজন পড়ে না। একজন শিশুর ঘুমের দৈনিক ঘণ্টার মোট পরিমাণ প্রতিদিনে খুব বেশি ওঠানামা করে না। তবে একেক শিশুর মধ্যে ঘুমের স্বাভাবিক পরিমাণের ফারাকটা বেশ বড়। শিশু যদি রাতে কম ঘুমায়, তবে দিনের বেলায় সে বেশি ঘুমাবে। রাতে বেশি ঘুমালে দিনে কম ঘুমাবে, এটাই নিয়ম।
শিশুর ঘুমের রুটিনে স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিকত্ব বলে কিছু নেই। এটি তখনই অস্বাভাবিক, তা যদি মা-বাবার ইচ্ছার সঙ্গে না মেলে। এই ঘুমের সমস্যার জন্য দিনে মা–বাবা ও শিশু উভয়ে ভীষণ ক্লান্ত থাকে।
অল্প বয়সে যে শিশু ঘুমের সমস্যায় পড়ে, পরবর্তী সময়ে সে তা নিয়েই বেড়ে ওঠে। শিশুর ঘুমের সমস্যার কারণ চিহ্নিত করতে পূর্বাপর ইতিহাস নেওয়া উচিত। বিশেষত টেমপারেমেন্ট ও সাইকোলজিক্যাল হিস্ট্রি। যেমন ২৫-৫০ শতাংশ অমনোযোগী ডানপিটে শিশু ঘুমের সমস্যায় ভোগে। শিশু যদি কান পাকা, অ্যাডিনয়েড ও টনসিল স্ফীতজনিত শ্বাসরোধ অসুখ, পেটব্যথা বা স্নায়ুতন্ত্রের রোগে আক্রান্ত থাকে, তবে ঘুমের সমস্যায় পড়তে পারে। এসব শিশুকে শারীরিক পরীক্ষার সঙ্গে বা কখনো ইইজিসহ মৃগী রোগে ভুগছে কি না, যাচাই করা প্রয়োজন।
শুরু থেকে শিশুর জন্য একটা ‘সুনিদ্রা অভ্যাস’ গড়ে তোলা উচিত। ঘুম ঘুম ভাব আছে, তবে সজাগ, এমন অবস্থায় শিশুকে ঘুমাতে নেওয়া উচিত।
এ সময়টার কিছু আগে থেকে তাকে খানিক মজাদার গল্প পড়িয়ে শোনানো, ছবি দেখানো বা সুরেলা গানে অভ্যস্ত করা স্বাস্থ্যকর। ঘুমের আগে বেশি ছোটাছুটি বা দৌড়ঝাঁপ–জাতীয় কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখা উচতি। বিছানায় যাওয়ার আগে শিশু যে যে পছন্দের জিনিস নিতে চায়, তা নিতে দেওয়া ভালো, যেমন প্রিয় খেলনা, পুতুল বা বই। তবে কোনো ধারালো কিছু বা বোতাম–জাতীয় জিনিস, যা থেকে আঘাত কিংবা হঠাৎ গিলে ফেলার মতো দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে, সে সম্পর্কে সাবধানতা জরুরি।
ঘুমাতে যাওয়ার আগের এক ঘণ্টা সময়কাল যেন শান্ত পরিবেশে থাকে। আলোহীন শোবার ঘর ও সহনীয় তাপমাত্রা (২৪ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের কম) থাকলে ভালো। শোবার ঘরে টেলিভিশন রাখা উচিত নয়।
শিশু যেন অভুক্ত ঘুমাতে না যায়। তবে ঘুমানোর এক থেকে দুই ঘণ্টার মধ্যে ভরপেট খাবার, কফি–চা, চকলেটের মতো ক্যাফেইনযুক্ত খাবার গ্রহণ ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। সবচেয়ে ভালো হয় ঘুমের অন্তত তিন ঘণ্টা আগে খাবার খাওয়ানো।
শিশুকে ‘শুভরাত্রি’ জানানো প্রতিদিন যেন একই রকমের হয়। ঘরের আলো নিভিয়ে দরজা বন্ধ করে আসুন। শোবার ঘরের আলো জ্বালিয়ে রাখার অর্থ—‘অন্ধকার এক ভয়ংকর ব্যাপার’, আর শোবার ঘরের দরজা খোলা রেখে দেওয়ার ইঙ্গিত—‘যখন ইচ্ছা তুমি বিছানা ছেড়ে চলে আসতে পারো’। এই বার্তা দেবেন না। যেন সে বুঝতে পারে, বিছানায় যাওয়ার পর টয়লেট বা জরুরি কাজ ছাড়া শয্যাত্যাগ নিষেধ। এ সময়ে তার সঙ্গে খেলা, কথা বলা, লাইট জ্বালানো–নেভানো এসব বাড়তি কিছু করা উচিত নয়।
যখনই শিশু বিছানা থেকে ডাক দেবে, তার ওপর নজর রাখবেন। তার ডাকে দ্রুত না গিয়ে খানিক বিলম্ব করে যান। তবে সে যেন বুঝে যে আপনি তার কাছেই আছেন।
শিশু যেন ঘুমের রুটিন মেনে চলে। স্কুল খোলা বা বন্ধের দিন একই সময় মেনে ঘুমাতে যাওয়া ও শয্যাত্যাগ করতে হবে। এতে পার্থক্য থাকলেও তা এক দিন থেকে অন্য দিনে যেন এক ঘণ্টার বেশি না হয়। যদি দিবানিদ্রা লাগে, তবে তা দিনের প্রথম ভাগে নির্দিষ্ট সময় মেনে করানো।
শিশু যেন প্রতিদিন খেলাধুলায় অংশ নেয় ও কায়িকশ্রমে যুক্ত থাকে।
অধ্যাপক ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, শিশুস্বাস্থ্য বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল