শিশুর ওজন কি বেশি হয়ে যাচ্ছে?
বয়স বাড়তে থাকলে স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ নিজের ওজন নিয়ে ভাবেন। উঠতি বয়সীদের কারও কারও মধ্যেও ওজনের ভাবনা কাজ করে। তবে শিশুদের বিষয়টা আলাদা। কতটা ওজন আসলে ‘বেশি ওজন’, কিংবা ওজন বেশি হলে সমস্যা কী—এসব ভাবনা শিশুমনে না আসাটাই স্বাভাবিক। তবে আশপাশে এমন অনেকেই থাকেন, যাঁরা অন্যের শারীরিক গড়ন নিয়ে হরহামেশাই কথা বলেন। তাঁদের ‘কথার অত্যাচার’ থেকে শিশুরাও রেহাই পায় না। আবার এক শিশু অন্য শিশুর গড়ন নিয়ে হাসাহাসি করছে, এমনটাও দেখা যায়।
যেকোনো বয়সেই মুটিয়ে যাওয়া ক্ষতিকর। অতিরিক্ত ওজন থাকলে অল্পতেই হাঁপিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, হাঁটুব্যথা এবং কোমরব্যথার ঝুঁকি বাড়ে। উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ এবং স্ট্রোকেরও ঝুঁকি বাড়ে। ধাপে ধাপে শিশুর ওজন কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা চালাতে হবে। শিশুর সঙ্গে অভিভাবকদেরও স্বাস্থ্যকর জীবনচর্চার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে, অনুকরণ করার মতো উদাহরণ হয়ে উঠতে হবে—এমনটাই বলছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের কনসালট্যান্ট তাসনুভা খান।
শিশুকে অতিরিক্ত ওজনের পরিণাম বুঝিয়ে বললেই যে সে পরদিন থেকে তার সব প্রিয় খাবার বাদ দিয়ে গপাগপ কেবল সেদ্ধ সবজি খাবে, আর দুই ঘণ্টা করে দৌড়াবে—তা তো নয়; বরং আইসক্রিম, চকলেট, কেক, পেস্ট্রি, জুস, বার্গার, পিৎজা, পাস্তার মতো সুস্বাদু খাবার না পেলে শিশুর মনমেজাজ বিগড়ে যাওয়ারই কথা। ‘জীবনটাকে রুটিনের মধ্যে আনতে হবে’ বলে একটা রুটিন তৈরি করে দিলেই যে সে আপনার করা রুটিনমাফিক জীবনযাপন করবে, এমনটাও নয়। তাই তাসনুভা খান জোর দিলেন পরিবারের অন্যদেরও একই রকম ইতিবাচক জীবনধারা গ্রহণ করার প্রতি।
পরিবারের খাবারদাবার
বাড়ির খাবার হতে হবে সুস্বাদু এবং পুষ্টিকর। পরিবেশনে কৌশলী হতে হবে, যাতে শিশু আগ্রহ পায়। এই যেমন মজার মজার আকৃতিতে সবজি কাটতে পারেন। তবে মনে রাখবেন, দীর্ঘদিনের খাদ্যাভ্যাস বদলে ফেলাটা চাট্টিখানি কথা নয়। ধীরেসুস্থে শুরু হোক পরিবর্তন। বাইরে খাওয়ার অভ্যাসও কমিয়ে আনতে হবে ধীরে ধীরে। ওর বয়সের উপযোগী করে বুঝিয়ে বলুন, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং শরীরচর্চা কেন জরুরি। পরিবারের সবাই মিলে খেতে বসুন। একই ধরনের খাবার খেতে চেষ্টা করুন। খাওয়ার পরিবেশটা রাখুন আনন্দময়। টেলিভিশন বা ভিডিও দেখতে দেখতে খাবেন না।
যতটুকু না দিলেই নয়, রান্নায় ঠিক ততটুকু তেলই দিন।
ভাতের পরিমাণ কমিয়ে দিন। শিশু যতটা খেয়ে অভ্যস্ত, তার থেকে এক টেবিল চামচ করে কমিয়ে আনুন রোজ। সবজির পরিমাণ বাড়িয়ে দিন। ফলমূলে উৎসাহ দিন।
ভাতের বদলে রুটি দিতে পারেন দুই বেলা। তবে দু-তিনটির বেশি নয়।
কোমল পানীয় বা জুস ধীরে ধীরে একেবারে বাদ দিয়ে দিতে হবে। বাড়িতে দুধ, মিল্কশেক, ফলের রস দিন; অবশ্যই চিনি ছাড়া, দিলেও খুব সামান্য।
চকলেট, মিষ্টান্ন, চিপস, ফাস্ট ফুড কমিয়ে আনুন।
ব্যায়াম হবে কীভাবে?
শহুরে পরিবেশে দৌড়ঝাঁপ কিংবা ছোটাছুটির সুযোগ কম বলে শহরের শিশুদের মধ্যে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বেশি। সারা দিনে ভাগে ভাগে এক–দুই ঘণ্টা আনন্দময় শরীরচর্চার ব্যবস্থা করুন। নিজেরাও সঙ্গে থাকুন। এতে পারিবারিক বন্ধনও দৃঢ় হবে।
স্কুলে যাওয়ার সময় যানবাহন থেকে এমন জায়গায় নামুন, যেখান থেকে স্কুলে পৌঁছাতে অন্তত ১৫ মিনিট হাঁটতে হয়। ১৫ মিনিট বা তার কম সময় হেঁটে পৌঁছানোর দূরত্বে স্কুল হলে যানবাহন নেবেন না।
সুযোগ পেলে রোজ অন্তত এক ঘণ্টা খেলার সুযোগ দিন মাঠে। পার্ক থাকলে সঙ্গে নিয়ে হাঁটুন বা দৌড়ান।
বাসার আশপাশে, গ্যারেজে বা ছাদে দড়িলাফ ও সাইকেল চালানোর ব্যবস্থা করুন।
ঘরেও ব্যায়াম হোক। ইউটিউব থেকে ঘরের ব্যায়াম শিখে নিতে পারেন। শিশুকে সঙ্গে নিয়ে সকাল-সন্ধ্যায় ব্যায়াম হতে পারে ঘরেই। সকালে ১৫-২০ মিনিট আগে ঘুম থেকে উঠলে ব্যায়ামের সময় পাবেন।
ছুটির দিনগুলোকে কাজে লাগান। খোলামেলা জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যান। শিশুর সঙ্গে ছোটাছুটি করুন।
ক্রিকেট, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন বা কারাতের প্রশিক্ষণে ভর্তি করাতে পারেন।
খেয়াল রাখুন
ডিজিটাল ডিভাইসের ওপর নির্ভরশীলতাও কিন্তু অতিরিক্ত ওজনের জন্য দায়ী। এখন তো বড়রাও আসক্ত। এই নেশা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে পরিবারের সবাইকে। অফিসের কাজও বাসায় না করাই ভালো।
তবে শিশুর ওজন হঠাৎ করেই দ্রুত বেড়ে যাওয়া, কম খেয়েও ওজন বাড়া কিংবা শিশুর অতিরিক্ত ওজনের সঙ্গে মনে রাখার ক্ষমতা কমে যাওয়া, বুদ্ধি কম থাকা, লম্বা না হওয়া, দৃষ্টি বা শ্রবণশক্তি কমে আসার মতো সমস্যা দেখা গেলে শিশুবিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।