অতিরিক্ত চা–কফি খেতে ভালোবাসেন? ক্যাফেইনের কারণে যে ৯ অসুবিধায় পড়তে পারেন

অতিরিক্ত চা–কফির আসক্তি বিপদ ডেকে আনতে পারে। মডেল: জান্নাতুল পিয়াছবি: কবির হোসেন

সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘অদ্ভুত চা খোর’ গল্পটা পড়া আছে? সেই যে এক লোক, ট্রেনে উঠে চা না পেয়ে শেষমেশ কাঁচা চা–পাতি চিবিয়ে মুখে গরম পানি ঢেলে দিয়েছিল। সেটা হয়তো গল্প। তবে অনেকেই আছেন, দিনে কয়েকবার চা–কফি না খেলে যাঁদের ‘মাথা কাজ করে না’। পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় দুই পানীয় কফি আর চা। এই দুই পানীয়তেই যে কমন উপাদানটি রয়েছে, সেটি হলো ক্যাফেইন। আমাদের মনমেজাজ, বিপাকক্রিয়া, মানসিক ও শারীরিক নানা কার্যক্রমে ভুমিকা রাখে ক্যাফেইন। গবেষণা বলছে, কম থেকে পরিমিত (৪০০ মিলিগ্রাম পর্যন্ত) ক্যাফেইন বেশির ভাগ ব্যক্তির দেহ কোনো নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না। এর চেয়ে বেশি ক্যাফেইন আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর। তবে কারও কারও শরীরিক গঠন আবার এমন যে নির্দিষ্ট পরিমাণের চেয়ে বেশি ক্যাফেইন গ্রহণের পরও তাঁর তেমন অসুবিধা হয় না। এটা অনেকটা ব্যক্তির জিনের সঙ্গে হজমক্ষমতার বোঝপড়ার বিষয়।

যাঁদের দেহে একদমই ক্যাফেইন সহ্য হয় না বা যাঁরা দিনরাত বেহিসাবি চা-কফি খান, তাঁদের যেসব পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে—

১. অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা: ক্যাফেইন সাধারণত আমাদের দেহের তৎপরতা বাড়ায়। এর ফলে শরীর হয়ে ওঠে চনমনে। ক্যাফেইন আমাদের শরীরের ক্লান্তি উৎপাদনকারী উপাদান ‘অ্যাডেনোসিন’কে বাধাগ্রস্ত করে, একই সঙ্গে ‘আড্রোনালিন’ হরমোন বাড়িয়ে শরীরে আনে এনার্জি। তাই ক্যাফেইনের ডোজ বেশি হলে এসব হরমোনের তৎপরতা বেড়ে গিয়ে দুশ্চিন্তা ও নার্ভাসনেসে রূপ নেয়। দিনে এক হাজার মিলিগ্রাম বা তার বেশি ক্যাফেইন গ্রহণে সেনসেটিভ মানুষদের প্যানিক অ্যাটাকের আশঙ্কা তৈরি হয়।

কফি

২. অনিদ্রা: অনেকেই চা-কফি পছন্দ করার অন্যতম কারণ এর ক্যাফেইন মানুষকে জাগিয়ে রাখে। ঘুম ঘুম ভাব দূর করে। তবে অতিরিক্ত ক্যাফেইনে অনিদ্রার সমস্যা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, মাত্রাতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণে পরিপূর্ণ ঘুম হয় না। ঘুম আসতেও অনেক সময় লাগে। তাই অনিদ্রার সমস্যা এড়াতে চাইলে চা-কফি পানের আগে এর পরিমাণ আর কখন খাচ্ছেন, সেদিকে নজর রাখুন।

৩. হজমজনিত সমস্যা: অনেকের কাছে সকালের এক কাপ কফি পেট সাফের দাওয়াই। তবে সকালে খালি পেটে কফি খাওয়ার অভ্যাস অনেক ক্ষেত্রেই গ্যাস্ট্রিকজনিত সমস্যার সৃষ্টি করে। অনেকে হয়তো এ জন্য ক্যাফেইনকে দায়ী করে ডি-ক্যাফেইন কফি পানের অভ্যাস করেন। তবে ডি-ক্যাফেইন কফিও গ্যাস্টিকজনিত সমস্যা তৈরি করতে পারে। এ ছাড়া অনেকেরই সকালে বেশি কফি খাওয়ার কারণে ডায়রিয়া পর্যন্ত হতে পারে।

বেশি ক্যাফেইন গ্রহণে পেশির গঠন নষ্ট হয়ে যায়

৪. পেশির গঠন নষ্ট: অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণে শরীরের পেশির ফাইবার অল্প অল্প করে ভেঙে রক্তের সঙ্গে মিশে যেতে পারে। মেডিকেলের ভাষায় একে বলে ‘র‍্যাবডোমাইলোসিস’। ট্রমা, ইনফেকশন, পেশিতে টান, মাদক গ্রহণ, বিষধর কোনো কিছুর কামড়ে ‘র‍্যাবডোমাইলোসিস’ হতে পারে। যদিও ক্যাফেইন গ্রহণে র‍্যাবডোমাইলোসিস হওয়ার ঘটনা খুব কম, তবে অনেকের ক্ষেত্রেই এমনটি হতে পারে। বিশেষ করে যদি কেউ অতিরিক্ত চা–কফিতে আসক্ত হয়ে পড়েন।

৫. আসক্তি: অতিরিক্ত চা-কফি পান অনেক সময় আসক্তিতে পরিণত হয়। গবেষণায় প্রমাণিত, অতিরিক্ত ক্যাফেইন আমাদের মস্তিষ্কে অনেকটা কোকেন বা অ্যাম্ফিটামিন ড্রাগের মতো কাজ করে। যদিও মানসিক ও শারীরিক অবস্থাভেদে এই আসক্তি একেকজনের একেক রকম। ক্যাফেইনের আসক্তি মাদকের মতো তীব্র বা জীবননাশী নয়, তবে অতিরিক্ত ক্যাফেইনে আসক্ত মানুষ উদ্ভট কাণ্ড ঘটাতে পারেন।

আরও পড়ুন
অতিরিক্ত ক্যাফেইনের কারণে (উদ্দীপনা বৃদ্ধিকারী প্রভাব থাকায়) হৃৎকম্পন বেড়ে যেতে পারে
ছবি: প্রথম আলো

৬. উচ্চ রক্তচাপ: ক্যাফেইন সরাসরি হৃদ্‌রোগ বা স্ট্রোকে ভূমিকা রাখে না। তবে এর উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী প্রভাব শিরা ও ধমনিতে রক্তচাপ বৃদ্ধি করে। উচ্চ রক্তচাপ রক্তের সুশৃঙ্খল চলাচলে বিঘ্ন ঘটিয়ে হৃৎপিণ্ড ও মস্তিষ্কে রক্তের প্রবাহে বাধা দেয় এবং হার্ট অ্যাটাক বা স্ট্রোকের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। সাধারণত রক্তচাপে ক্যাফেইনের প্রভাব সাময়িক। তবে যাঁরা ক্যাফেইন সহ্য করতে পারেন না, তাঁরা অতিরিক্ত গ্রহণের আগে নিজের রক্তচাপ বুঝে নিন। পরিমাণ ও সময় বুঝে তাঁদের চা–কফি খেতে হবে।

৭. হৃৎকম্পন বেড়ে যাওয়া: অতিরিক্ত ক্যাফেইনের কারণে (উদ্দীপনা বৃদ্ধিকারী প্রভাব থাকায়) হৃৎকম্পন বেড়ে যেতে পারে। যেসব তরুণ অতিরিক্ত ক্যাফেইনযুক্ত এনার্জি ড্রিংকস পান করেন, সাধারণত তাঁদের মধ্যে হৃৎকম্পনের পরিবর্তিত উত্থান-পতন বেশি লক্ষ করা যায়। তাই যদি হৃৎকম্পন স্বাভাবিকের চেয়ে অন্য রকম মনে হয়, ক্যাফেইন খাওয়ার পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া উচিত।

৮. ক্লান্তি: চা-কফি সচরাচর আমরা এনার্জি বাড়ানোর জন্য খাই। তবে অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণে বিপরীতটাও হতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, যদিও ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় কয়েক ঘণ্টার জন্য মানসিক শক্তি, সতর্কতা ও মুডকে চাঙা করে, তবে পরবর্তী সময় বা দিনের জন্য আমাদের শরীরের ক্লান্তি ও অবসাদ আরও বেশি করে তৈরি করে। তাই অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণ না করে মাত্রা বজায় রেখে খেলেই উপকার পাওয়া যাবে।

৯. ঘন ঘন ওয়াশরুমের ব্যবহার: ক্যাফেইন শুধু আমাদের মস্তিষ্কের উদ্দীপনা বৃদ্ধি করে তা নয়, মূত্রথলিতেও এর চাপ পড়ে। খেয়াল করে দেখবেন, অনেকেই চা-কফি খাওয়ার পরপরই ওয়াশরুমের দিকে দৌড়ান।

কম বা সহনীয় মাত্রার ক্যাফেইন মূলত দেহের জন্য সবচেয়ে বেশি ভালো। তাই আমাদের প্রিয় চা-কফির ক্যাফেইন থেকে উপকারিতা পেতে চাইলে অবশ্যই শারীরিক অবস্থা, ঘুমের সময় বুঝে খেতে হবে।

সূত্র: হেলথলাইন

আরও পড়ুন