ঘাড়ে গ্ল্যান্ড টিবি হলে কীভাবে বোঝা যায়, চিকিৎসা কী
পৃথিবীতে যত যক্ষ্মা বা টিবি রোগী আছে, এর প্রায় অর্ধেক আমাদের এই উপমহাদেশে। এই অবস্থার জন্য দায়ী যক্ষ্মা রোগ সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং সঠিক সময়ে টিকা না নেওয়া। তাই অজ্ঞতা দূর করে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে আজ বিশ্বব্যাপী পালিত হচ্ছে বিভিন্ন কর্মসূচি।
১৮৮২ সালের ২৪ মার্চ জার্মান চিকিৎসক ও অণুজীববিজ্ঞানী ডা. রবার্ট কচ আবিষ্কার করেন যক্ষ্মা বা টিবি রোগের জীবাণু ‘মাইকোব্যাটেরিয়াম টিউবারকিউলোসিস’। এই জীবাণু আবিষ্কারের ১০০ বছর পর, ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ, জীবাণু আবিষ্কারের দিনটি স্মরণীয় করে রাখতে এবং যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতিবছরের এই দিনে পালিত হয়ে আসছে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস।
এবার, অর্থাৎ ২০২৫ সালে বিশ্ব যক্ষ্মা দিবসের স্লোগান হলো ‘হ্যাঁ! আমরা টিবি নিঃশেষ করতে পারি! আসুন, আমরা ঐক্যবদ্ধ হই, পদক্ষেপ নিই এবং আমাদের প্রতিশ্রুতি নবায়ন করি’।
ফুসফুসে যক্ষ্মা হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি—৮৫ শতাংশ। তাই জনমনে ধারণা, যক্ষ্মা মানেই ফুসফুসের রোগ। আদতে তা নয়। দু-একটা ব্যতিক্রম ছাড়া আমাদের শরীরে এমন কোনো অঙ্গ নেই, যেখানে টিবি রোগ হয় না।
গ্ল্যান্ড টিবি কী, লক্ষণই-বা কী
রোগীর ঘাড়ে বা গলার চারপাশে কয়েক দিন ধরে ফুলে যাওয়া গোটা, যা ধীরে ধীরে বড় হচ্ছে; সঙ্গে সন্ধ্যার পর জ্বর, ওজন কমে যাওয়া; হাত দিলে গোটাগুলো গরম লাগা—এসবই অন্যতম লক্ষণ। আমাদের শরীরের বিভিন্ন স্থানে এই গুটি বা লসিকাগ্রন্থি (লিম্ফ নোড) থাকে। ঘাড়ের দুই পাশে আছে তিন শর মতো লিম্ফ নোড। এসবের মূল কাজ রক্ত পরিষ্কার রাখা এবং রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করা। যক্ষ্মার কারণে যাঁদের ঘাড়ের লসিকাগ্রন্থি ফোলে, তাঁদের গুটিগুলোতে ব্যথা থাকে না। বরং একটার সঙ্গে আরেকটা দলা পাকিয়ে থাকে। কারও কারও গুটি ফেটে রস (ডিসচার্জিং সাইনাস) বের হয়, অর্থাৎ কখনো কখনো নোডগুলো পেকে ফেটে যায়।
লসিকাগ্রন্থি ফোলা নিয়ে আসা রোগীদের ক্ষেত্রে রোগ নিরূপণের জন্য সাধারণ রক্ত পরীক্ষার পাশাপাশি আক্রান্ত গ্রন্থি থেকে সুচের মাধ্যমে কোষকলা নিয়ে এফএনএসি নামক সাইটোপ্যাথলজিক্যাল পরীক্ষা করা হয়, যার মাধ্যমে সহজে গ্ল্যান্ড টিবি নির্ণয় করা সম্ভব। অনেক সময় ক্ষেত্রবিশেষে বায়োপসি লাগতে পারে।
গ্ল্যান্ড টিবির চিকিৎসা
ঘাড়ে বা গলার চারপাশের লিম্ফ নোড থেকে টিবি রোগ ধরা পড়লে কী করা হয়? গ্ল্যান্ড টিবির ক্ষেত্রে রোগীর ওজন অনুযায়ী ৬-৯ মাস, এমনকি ১ বছর পর্যন্ত খেতে হতে পারে। তবে মনে রাখতে হবে, গ্ল্যান্ড টিবিতে আক্রান্ত রোগীর ফোড়া হলে অবশ্যই অস্ত্রোপচার করে তা কেটে ফেলতে হবে। কারণ, পুঁজ থাকলে টিবির ওষুধ কাজ করবে না। তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে বলে রাখা দরকার, চিকিৎসা শুরু হওয়ার পর প্রথম দিকে আক্রান্ত গ্রন্থি হঠাৎ আরেকটু বড় হয়ে যেতে পারে বা নতুন করে কোনো গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে। এতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। টিবির ওষুধ চলাকালে পুষ্টিকর খাওয়াদাওয়া প্রয়োজন। ওষুধের কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে, যেমন জন্ডিসের ভাব দেখা দিলে, চোখে ঝাপসা দেখলে অবিলম্বে চিকিৎসককে জানানো দরকার। রোগী যেন কখনোই নিজে থেকে ওষুধ বন্ধ না করেন।
দারিদ্র্যের কারণে অনেকেই রোগের লক্ষণ গোপন করে যান। মানুষকে ব্যাপকভাবে জানানো দরকার যে যক্ষ্মার চিকিৎসার সুযোগ আছে বিনা মূল্যে। একসময় বলা হতো, ‘যার হয় যক্ষ্মা, তার নাই রক্ষা’। এরপর চিকিৎসাবিজ্ঞানের উত্তরোত্তর উন্নতির ফলে এই ধারণা বদলে গেছে অনেকাংশে। এখন বলা হয়, ‘যক্ষ্মা হলে রক্ষা নাই, এই কথার ভিত্তি নাই’।
ডা. মো. আব্দুল হাফিজ শাফী, এফসিপিএস (ইএনটি); নাক কান গলা রোগ বিশেষজ্ঞ এবং হেড-নেক সার্জন; আবাসিক সার্জন (ইএনটি), সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সিলেট