হৃদ্রোগ নিয়েও ভালো থাকা যায়?
হৃৎপিণ্ড বৈকল্য বা হার্ট ফেইলিওর হওয়া মানে আপনার হৃদ্যন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করছে না। এটি কোনো রোগ নয়; বরং নানা ধরনের হৃদ্রোগের উপসর্গ। তাই এটা ধরা পড়লে আগে কারণ খুঁজে বের করা দরকার।
হৃৎপিণ্ডের মূল কাজ হলো সারা শরীরে রক্ত পাম্প বা সঞ্চালন করা। প্রতিমুহূর্তে অঙ্গটি শরীরে জালের মতো বিস্তৃত রক্তনালিতে রক্ত সরবরাহ করে থাকে। এই সরবরাহক্ষমতা কোনো কারণে কমে গেলে হার্ট ফেইলিওর হয়। এটি সাধারণত দুই রকম—হঠাৎ করে, কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিনের মধ্যে হৃৎপিণ্ডে বৈকল্য দেখা গেলে বা হৃৎপিণ্ডের সঞ্চালনক্ষমতা কমে গেলে তাকে বলে অ্যাকিউট বা আকস্মিক হার্ট ফেইলিওর। এই সময়ের মধ্যে রোগীর হঠাৎ খুব শ্বাসকষ্ট হতে থাকে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন বা কয়েক মাস বা বছরব্যাপী ঘটে ক্রনিক বা দীর্ঘমেয়াদি হার্ট ফেইলিওর। দীর্ঘদিন ধরে রোগী শ্বাসকষ্টে ভোগেন, দিন দিন বাড়ে এর তীব্রতা।
পরিণত বয়সী জনগোষ্ঠীর প্রায় ১ থেকে ২ শতাংশ মানুষ হৃৎপিণ্ডের বৈকল্য সমস্যায় ভোগেন। সত্তরোর্ধ্ব ব্যক্তিদের মধ্যে এই হার ১০ শতাংশের বেশি। ৬৫ বছরের বেশি বয়সী, যাঁরা শ্বাসকষ্ট নিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসেন, তাঁদের ছয়জনের একজন হার্ট ফেইলিওরের রোগী।
হৃৎপিণ্ড বৈকল্যের কারণ
হৃৎপিণ্ডের বৈকল্য একক কোনো রোগ নয়। এটি নানা ধরনের হৃদ্রোগের একধরনের বহিঃপ্রকাশ বা উপসর্গ। তাই হার্ট ফেইলিওর ধরা পড়লে আগে পেছনের কারণটা খুঁজে বের করা দরকার। বেশির ভাগ হৃদ্রোগই নীরব ঘাতক। কোনো উপসর্গ ছাড়াই ধীরে ধীরে এসব রোগ শরীরে বাসা বাঁধতে থাকে। পরে আকস্মিক বা দীর্ঘমেয়াদি হার্ট ফেইলিওরের মাধ্যমে প্রকাশ পায়।
হার্ট অ্যাটাক: চর্বি জমাট বেঁধে হৃৎপিণ্ডের রক্তনালি সরু হয়ে যাওয়ার কারণে হার্ট অ্যাটাক হয়। মানে হার্টের কোনো বিশেষ স্থানে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে যায় বা কমে যায়। হার্ট ফেইলিওরের প্রধান কারণ হলো এই হার্ট অ্যাটাক। হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসা সময়মতো ও যথাযথ না হলে কিংবা হার্ট অ্যাটাকের পর নিয়মিত ওষুধ না খেলে, নিয়মকানুন না মানলে পরবর্তী সময়ে হার্ট ফেইলিওর হওয়া, মানে হার্টের কার্যক্ষমতা স্থায়ীভাবে কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে।
উচ্চ রক্তচাপ: উচ্চ রক্তচাপ হার্ট ফেইলিওরের আরেকটি অন্যতম কারণ। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে না থাকলে যেকোনো সময় রক্তচাপ খুব বেড়ে গিয়ে হার্ট ফেইলিওর হতে পারে। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের কারণে ধীরে ধীরে হার্ট বড় হয়ে যায়, ধীরে ধীরে কার্যক্ষমতা কমে যেতে থাকে।
জন্মগত হৃদ্রোগ: জন্মগত হৃদ্রোগের উপসর্গ কোন বয়সে প্রকাশ পাবে, নির্ভর করে রোগের ধরন ও মাত্রার ওপর। জন্মগত ত্রুটি মারাত্মক হলে ও সময়মতো ধরা না পড়লে বা চিকিৎসা না করা হলে একটা সময় গিয়ে হার্ট ফেইলিওর হতে পারে।
হার্টের ভালভের অসুখ: হার্ট ভালভের অসুখ (জন্মগত, বয়সকালীন কিংবা বাতজ্বরজনিত) হার্ট ফেইলিওরের কারণ।
অনিয়মিত হৃৎস্পন্দন: খুব দ্রুত ও অনিয়মিত হৃদস্পন্দনজনিত রোগ হার্ট ফেইলিওরের জন্য দায়ী।
রক্তশূন্যতা: রক্তশূন্যতার মাত্রা তীব্র হলে হার্ট ফেইলিওর হতে পারে।
হৃৎপিণ্ডের প্রদাহ: হৃৎপিণ্ডের যেকোনো প্রদাহই হার্টের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
হার্টের মাংসপেশির অসুখ: হৃৎপিণ্ডের মাংসপেশির অসুখকে বলে কার্ডিওমায়োপ্যাথি। কিছু কিছু কার্ডিওমায়োপ্যাথির কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কার্ডিওমায়োপ্যাথির পেছনে বংশগতির প্রভাব থাকে। ডায়াবেটিস, স্থূলতা, থাইরয়েড ও হরমোনজনিত রোগের কারণে হতে পারে কার্ডিওমায়োপ্যাথি। অতিরিক্ত মদ্যপান ও যথেচ্ছ মাদক গ্রহণও কার্ডিওমায়োপ্যাথির কারণ। প্রসবকালীন শেষ তিন মাস ও প্রসব–পরবর্তী পাঁচ মাসের মধ্যে কার্ডিওমায়োপ্যাথি হয়ে হার্ট ফেইলিওর হতে পারে। একে ‘গর্ভকালীন হার্ট ফেইলিওর’ বলে। অত্যধিক মানসিক চাপ থেকেও অনেক সময় হার্ট ফেইলিওর হয়। একে বলে ‘স্ট্রেস কার্ডিওমায়োপ্যাথি’।
হৃৎপিণ্ড বৈকল্যের উপসর্গ
শ্বাসকষ্ট হলো হার্ট ফেইলিওরের প্রধান উপসর্গ। ওদিকে ফুসফুসের রোগসহ অন্য কিছু রোগেরও প্রধান উপসর্গ শ্বাসকষ্ট। তাই শ্বাসকষ্ট হলেই তা হার্ট ফেইলিওরের জন্য কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে হবে।
অল্প পরিশ্রমে শ্বাসকষ্ট বা হাঁপ, চিৎ হয়ে শুলে শ্বাসকষ্ট বা রাতে ঘুমানোর পর শ্বাসকষ্টে হঠাৎ ঘুম ভেঙে যাওয়া—এগুলো হার্ট ফেইলিওরের লক্ষণ।
শুরুতে দ্রুত হাঁটা বা দৌড়ানোর মতো পরিশ্রমে শ্বাসকষ্ট হয়।
ধীরে ধীরে কম পরিশ্রম বা অল্প হাঁটলে অথবা নিজের দৈনন্দিন কাজ (যেমন কাপড় পাল্টানো বা গোসল) করতে গেলেও শ্বাসকষ্ট হতে শুরু করে।
হাত-পা, পুরো শরীর সব সময় অস্বাভাবিক ঠান্ডা থাকা বা রক্তচাপ অস্বাভাবিক কমে যাওয়াও সন্দেহের বিষয়।
অনেকের দুই পা ও পেটে পানি জমে যায়, প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায়। এগুলো ক্রনিক হার্ট ফেইলিওরের লক্ষণ।
যদি হঠাৎ প্রচণ্ড শ্বাসকষ্ট হয়, তবে সন্দেহ করতে হবে অ্যাকিউট হার্ট ফেইলিওর। এমন অবস্থা হলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে।
কীভাবে নিশ্চিত হবেন?
অভিজ্ঞ চিকিৎসক রোগীর রোগ ইতিহাস শুনে এবং হাত, পা, বুক, চোখ, নাড়ির গতি ও রক্তচাপ পরীক্ষা করে হার্ট ফেইলিওর সম্পর্কে মোটামুটি নিশ্চিত হতে পারেন। তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ল্যাবরেটরিতে কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। যেমন রক্তের এন-টি প্রো বিএনপির (এন-টারমিনাল প্রোহরমোন অব ব্রেইন নেট্রিউরেটিক পেপটাইড) মাত্রা পরীক্ষা এবং ইকোকার্ডিওগ্রাম করা খুব দরকারি। হার্ট ফেইলিওরের কারণ খুঁজতে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার হতে পারে। ইকোকার্ডিওগ্রামের সাহায্যে হার্ট ফেইলিওর নিশ্চিত হওয়ার পাশাপাশি কারণটাও জানা যায়। হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি না, দেখতে রক্তের ট্রপোনিনের মাত্রা, ইসিজি ও করোনারি এনজিওগ্রামের দরকার পড়ে। কিছু জন্মগত হৃদ্রোগ ও কার্ডিওমায়োপ্যাথির ক্ষেত্রে হার্টের সিটি স্ক্যান বা এমআরআই পরীক্ষাও করতে হয়।
চিকিৎসা
অ্যাকিউট ও ক্রনিক হার্ট ফেইলিওরের চিকিৎসা পদ্ধতি ভিন্ন। অ্যাকিউট হার্ট ফেইলিওরের রোগীকে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে ভর্তি করে চিকিৎসা দিতে হয়। ক্রনিক হার্ট ফেইলিওরের রোগীকে বাড়িতে রেখেই হার্টের কার্যক্ষমতা বাড়ানোর ওষুধ দেওয়া হয়। হার্ট ফেইলিওরের চিকিৎসায় চিকিৎসকের পরামর্শমতো সারা জীবন ওষুধ চালিয়ে যেতে হবে। ওষুধের পাশাপাশি হৃৎপিণ্ডের কার্যক্ষমতা আরও বাড়ানোর জন্য উপযুক্ত রোগীর হার্টে সিআরটি নামের যন্ত্র বসানো হয়। এটি ব্যাটারিচালিত একটি ছোট যন্ত্র, যা বুকের উপরিভাগে চামড়ার নিচে স্থাপন করা হয় এবং বিশেষ তারের মাধ্যমে যন্ত্রটিকে হৃৎপিণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। হার্ট ফেইলিওর রোগীদের সব ধরনের চিকিৎসা এখন দেশেই হয়।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, হৃদ্রোগ বিভাগ, জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা