নিশ্চিন্তে সেন্টেড ক্যান্ডেল বা সুগন্ধি মোমবাতি জ্বালানোর আগে জেনে নিন এর ভয়ানক স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা

ঘরের আবহ বদলে দেয় মোমবাতির আলো। ছড়ায় আরামদায়ক উষ্ণতা। সঙ্গে সুঘ্রাণ থাকলে তো সোনায় সোহাগা। তাই সেন্টেড ক্যান্ডেল বা সুগন্ধিযুক্ত মোমবাতির কদর বাড়ছেই। বিভিন্ন ফুল ও ফলের ঘ্রাণ থেকে শুরু করে নানা সুগন্ধি মসলা, যেমন দারুচিনি, লবঙ্গ ইত্যাদির ঘ্রাণযুক্ত মোমবাতি কিনছেন অনেকে। এদিকে এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত ও দীর্ঘ সময় এ ধরনের মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখলে স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বয়ে আনতে পারে।

নিয়মিত ও দীর্ঘ সময় সুগন্ধী মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখলে স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি বয়ে আনতে পারেছবি: পেক্সেলস

জ্বলন্ত মোমবাতি কী করে

এ বছর ফেব্রুয়ারিতে নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা বলছে, মোমবাতি থেকে নির্গত ধোঁয়া শ্বাসের সঙ্গে মানবদেহে প্রবেশ করলে মস্তিষ্কের কার্যকারিতা হ্রাস পায়, সম্ভবত মস্তিষ্কে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। যৌথভাবে গবেষণাটি করেছে বার্মিংহাম এবং ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষণাকালে একটি বদ্ধ ঘরে মোমবাতি জ্বালিয়ে এক ঘণ্টার জন্য কয়েকজন স্বেচ্ছাসেবককে রাখা হলে দেখা যায়, মনোযোগ এবং আবেগ প্রয়োজন হয়, এমন কাজ করার ক্ষেত্রে তাদের কার্যক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ওই গবেষণায় বলা হয়, বদ্ধ ঘরে কখনোই মোমবাতি জ্বালানো উচিত নয়, এমনকি খুব অল্প সময়ের জন্যও নয়।

ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিনের তথ্যও বলছে, ঘরের ভেতরের বাতাস দূষিত হওয়ার একটি বড় কারণ মোমবাতি। এ বিষয়ে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞানবিষয়ক অধ্যাপক ক্রিশ্চিয়ান ফাং বলেন, ‘মোমবাতি আমাদের আরামদায়ক অনুভূতি দেয়। তবে এর প্রভাব আমরা অনেকেই বুঝতে পারি না।’

সেন্টেড ক্যান্ডেল জ্বলন্ত অবস্থায় ফর্মালডিহাইড নির্গত করে, যা ত্বক, কণ্ঠনালি, ফুসফুস ও চোখের ক্ষতি করে
ছবি: পেক্সেলস

মোমবাতিতে উপস্থিত অতিসূক্ষ্ম কণা বাতাস দূষিত হয়, আর তা শ্বাসের সঙ্গে সহজেই ফুসফুসে প্রবেশ করে। এতে শ্বাসকষ্টের সমস্যা ও হৃদ্‌রোগ হতে পারে। অন্তঃসত্ত্বা নারীরা জন্ম দিতে পারেন কম ওজনের শিশু। তা ছাড়া মোমবাতি থেকে নির্গত কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও সালফার ডাই–অক্সাইড তৈরি হয়, এসবই ক্ষতিকর ও বায়ুদূষণকারী উপাদান।

সালফার ডাই–অক্সাইডযুক্ত বাতাসে খুব অল্প সময় জন্য শ্বাস নিলেও শ্বাসযন্ত্রের ক্ষতি হয়, পরবর্তী সময়ে যা শ্বাসপ্রশ্বাসে অসুবিধা সৃষ্টি করে। অধ্যাপক ফাং বলেন, ‘হাঁপানিতে আক্রান্ত শিশু ও বয়স্করা এতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। সালফার ডাই–অক্সাইড অন্যান্য যৌগের সঙ্গে বিক্রিয়া করে যে কণা তৈরি করে, তা আমাদের ফুসফুসের গভীরে প্রবেশ করতে পারে, যা হতে পারে গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ।’

বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞানের আরেক অধ্যাপক ফ্রান্সিস পোপ বলেন, ‘এটি সুপ্রমাণিত যে শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের সরাসরি প্রভাব আছে। এখন মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বায়ুদূষণের প্রভাব কতটুকু, তা যাচাই করা প্রয়োজন।’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা মোতাবেক, বাতাসে অতিক্ষুদ্র কণার ঘনত্ব পিএম ২.৫–এর বেশি হলে তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু অধ্যাপক পোপের গবেষণা দল পরীক্ষা করে দেখেছে, সুগন্ধিহীন বা সাধারণ মোমবাতি জ্বালালেই বাতাসে অতিক্ষুদ্র কণার ঘনত্ব পিএম ২.৫ থেকে অনেক বেড়ে যায়। পরীক্ষায় দেখা যায়, ঘরের ভেতরে এই দূষিত বাতাসে মাত্র এক ঘণ্টা শ্বাস নেওয়ার পর চিন্তাশক্তি ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্মক্ষমতা কমে যাচ্ছে। পোপ বলেন, ‘আজকাল অনেক গবেষণাই বলছে, বায়ুদূষণের সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যের মধ্যে যোগসূত্র আছে, যা স্বল্প কিংবা দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। ডিমেনশিয়া ও আলঝেইমারস ডিজিজের মতো মনে রাখতে না পারা রোগের সঙ্গে বায়ুদূষণের সম্পর্ক পাওয়া গেছে।’

প্রাকৃতিক তেল থেকে তৈরি সুগন্ধিও পোড়ানো উচিত নয়
ছবি: পেক্সেলস

সুগন্ধের বিষয়ে

ত্বকে সুগন্ধি মাখার চেয়ে সুগন্ধি পোড়ানোর ক্ষতি বেশি। সেন্টেড ক্যান্ডেল জ্বলন্ত অবস্থায় অ্যালডিহাইড, বিশেষ করে ফর্মালডিহাইড নির্গত করে, যা স্বাস্থ্যের জন্য বেশ খারাপ। এটি ত্বক, কণ্ঠনালি, ফুসফুস ও চোখের ক্ষতি করে। মাথাব্যথা, মাথা ঘোরা ও অ্যালার্জির মতো সমস্যা তৈরি করতে পারে।

মোমবাতিতে উপস্থিত সুগন্ধি পদার্থের দহনে বেনজিন ও পলিসাইক্লিক অ্যারোম্যাটিক হাইড্রোকার্বনের মতো উদ্বায়ী জৈব যৌগ থাকলে তা শরীরে ক্যানসার পর্যন্ত সৃষ্টি করতে পারে। তাই বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থের মিশ্রণে তৈরি কৃত্রিম সুগন্ধি এড়িয়ে চলা উচিত। এমনকি প্রাকৃতিক তেল থেকে তৈরি সুগন্ধিও পোড়ানো উচিত নয়। কারণ, অনেক সময় এসবেও ফর্মালডিহাইড থাকে।

আরও পড়ুন

কোন মোমবাতি নিরাপদ

সুগন্ধি হিসেবে রাসায়নিক যুক্ত করা নেই, এমন মোমবাতি ক্ষতিকারক অ্যালডিহাইড নির্গত করে না
ছবি: পেক্সেলস

সচেতনভাবে ব্যবহার করলে সাধারণত সব মোমবাতিই নিরাপদ। তবে কিছু সুগন্ধিযুক্ত মোমবাতি তুলনামূলক বেশি ক্ষতিকর। যেমন মোমবাতিতে যদি মোম বা প্যারাফিনের তুলনায় সালফারের পরিমাণ বেশি থাকে, তা জ্বালালে ক্ষতিকর সালফার ডাই–অক্সাইড উৎপন্ন করে।

এসব মাথায় রেখে আজকাল তাই প্রাকৃতিক উপকরণ দিয়ে মোমবাতিতে সুগন্ধি যুক্ত করা হচ্ছে। এ ধরনের মোমবাতি ক্লিন-বার্নিং, অর্থাৎ প্রজ্বলিত অবস্থায় কোনো প্রকার ক্ষতিকর গ্যাস উৎপন্ন করে না। যেমন সয়াবিন ওয়াক্স ও বি ওয়াক্স দিয়ে তৈরি মোম।

সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপকরণে তৈরি মোমবাতি ব্যবহার করা প্রসঙ্গে অধ্যাপক ফাং বলেন, ‘সুগন্ধি হিসেবে রাসায়নিক যুক্ত করা নেই, এমন মোমবাতি ক্ষতিকারক অ্যালডিহাইড নির্গত করে না। আপনি সুস্থ–সবল হলে মাঝেমধ্যে অল্প সময়ের জন্য এ ধরনের মোমবাতি জ্বালালে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না।’

তবে দীর্ঘ মেয়াদ যেন কোনো সমস্যা না হয়, এর জন্য কিছু কৌশল জেনে রাখতে পারেন।

যা করতে হবে

  • মোমের সুতাটি যেন সঠিক দৈর্ঘ্যের হয়। জ্বলন্ত অবস্থায় সুতায় বা তার নিচে কালি হলে এবং কালো ধোঁয়া দেখতে পেলে বুঝবেন, বায়ুদূষণ হচ্ছে।

  • টানা অনেকক্ষণ মোমবাতি জ্বালাবেন না। কারণ, মোম যত পোড়ে, তত বেশি ক্ষতিকর উদ্বায়ী জৈব যৌগ তৈরি হয়। অধ্যাপক ফাংয়ের মতে, শোবার ঘরে মোমবাতি না জ্বালানোই ভালো।

  • নিজের খুব কাছাকাছি মোমবাতি রাখবেন না। কাছে গিয়ে শ্বাস নেবেন না।

  • দরজা-জানালা আটকানো বদ্ধ ঘরে মোমবাতি জ্বালাবেন না। জ্বালানোর আগে ঘরের অন্তত একটি জানালা খুলে দিন।

সূত্র: দ্য টেলিগ্রাফ

আরও পড়ুন