বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও থ্যালাসেমিয়ার প্রকোপ কম নয়। জন্মগত এই রোগে হিমোগ্লোবিনের গঠনগত ত্রুটির কারণে রোগীর দেহে রক্ত কমে যায়। এ জন্য বারবার রক্ত দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। পাশাপাশি শরীরও প্রয়োজনীয় রক্ত তৈরি করতে খাদ্য থেকে অতিমাত্রায় আয়রন শোষণ করতে সচেষ্ট হয়। এই দুয়ের ফলে রক্তে আয়রনের মাত্রা বেড়ে যেতে থাকে এবং তা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গে জমতে থাকে।
নানাবিধ চিকিৎসার মাধ্যমে আয়রনের মাত্রা কমানোর চেষ্টা করা হলেও অনেক ক্ষেত্রে এর আধিক্যের কারণে রোগীর সার্বিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। হরমোনের ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়।
উপসর্গ ও ক্ষতি
থ্যালাসেমিয়ার উল্লেখযোগ্য উপসর্গ হলো শিশুর খর্বতা। ১০-১১ বছরে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। পিটুইটারি গ্রন্থিতে অতিরিক্ত আয়রন জমে যাওয়ায় গ্রোথ হরমোনের সরবরাহ কমে যাওয়ায় খর্বতা দেখা দেয়। অবশ্য শিশুর খর্ব হওয়ার অন্য কারণও থাকতে পারে। যেমন দীর্ঘমেয়াদি রক্তস্বল্পতা, লিভারের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া, প্লীহার অতি কর্মতৎপরতা, তরুণাস্থির বৃদ্ধি কমে যাওয়া ইত্যাদি।
গোনাডোট্রপিন হরমোনের নিঃসরণ কমে গেলে বয়ঃসন্ধিকাল আসতে দেরি হয়। ফলে কাঙ্ক্ষিত সেক্স হরমোনের অভাবে শিশুর লম্বা হওয়া আরও ব্যাহত হয়। জননাঙ্গগুলো পরিপূর্ণ বিকাশ লাভ করে না।
অতিরিক্ত আয়রন জমে যাওয়ায় অন্যান্য গ্রন্থি, যেমন থাইরয়েড, প্যারাথাইরয়েড, অ্যাডরেনাল গ্রন্থি ও প্যানক্রিয়াসের কার্যক্ষমতা কমে যায়।
প্যানক্রিয়াস গ্রন্থি থেকে পর্যাপ্ত ইনসুলিন নিঃসৃত না হলে রোগী অল্প বয়সে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারে।
প্যারাথাইরয়েড গ্রন্থি থেকে পর্যাপ্ত প্যারাথরমোন নিঃসৃত না হলে শরীরে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস ও ভিটামিন ডির ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। ফলে হাড়ের ক্ষয় বৃদ্ধি পায় ও হাড় দুর্বল হয়ে যায়। রোগী পায়ে ব্যথা অনুভব করতে পারে। খিঁচুনি হতে পারে। এমনকি হার্টের মতো অপরিহার্য অঙ্গের কার্যক্ষমতা কমে যেতে পারে।
অ্যাডরেনাল গ্রন্থির সমস্যা তুলনামূলক কম দেখা গেলেও অতি দুর্বলতা, শুকিয়ে যাওয়া ও মাংসপেশির শক্তি কমে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
প্রতিরোধ ও চিকিৎসা
গবেষণায় দেখা গেছে, কার্যকর চিকিৎসার পরও থ্যালাসেমিয়া রোগীর মধ্যে থাইরয়েড হরমোনের মাত্রা কমে যাওয়ার হার ১৮ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। ফলে রোগীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
সম্ভাব্য হরমোনের সমস্যা প্রতিরোধে সচেষ্ট হতে হবে। প্রথম থেকেই প্রয়োজনমাফিক নিয়মিত শরীরে রক্ত নিতে হবে। কোনো অবস্থায় হিমোগ্লোবিনের মাত্রা ৯.৫ গ্রাম/ডিএলের নিচে নামতে দেওয়া যাবে না।
আয়রনের মাত্রা সীমিত রাখতে সঠিকভাবে ডেসফেরোক্সামিন নিতে হবে।
জটিলতা এড়াতে ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী জিংক, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন সি ও ডির জোগান নিশ্চিত করতে হবে।
স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হলে হরমোনজনিত সমস্যা চিহ্নিত করতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হরমোন পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে।
ডা. রবি বিশ্বাস, সহযোগী অধ্যাপক ও শিশু হরমোন বিশেষজ্ঞ, ঢাকা শিশু হাসপাতাল