জয়েন্টে ব্যথা উপেক্ষার নয়

বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষের খুব সাধারণ একটি অসুখ হচ্ছে জয়েন্টে ব্যথা। এ নিয়ে আলোচনা হলো এসকেএফ নিবেদিত বিশেষ অনুষ্ঠান ব্যথার সাতকাহনের প্রথম পর্বে।

ডা. শ্রাবণ্য তৌহিদার সঞ্চালনায় অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের হ্যান্ড অ্যান্ড রিকনস্ট্রাক্টিভ সার্জারি অর্থোপেডিকস বিভাগের অধ্যাপক কৃষ্ণ প্রিয় দাস (নিচে ডানে), যোগব্যায়াম প্রতিষ্ঠান ইয়োগানিকার ইয়োগা ইন্সট্রাক্টর অ্যান্ড হেলথের কোচ আনিকা রাব্বানী (উপরে ডানে) এবং বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার এনামুল হক বিজয় (নিচে বাঁয়ে)

অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের হ্যান্ড অ্যান্ড রিকনস্ট্রাক্টিভ সার্জারি অর্থোপেডিকস বিভাগের অধ্যাপক কৃষ্ণ প্রিয় দাস, যোগব্যায়াম প্রতিষ্ঠান ইয়োগানিকার ইয়োগা ইন্সট্রাক্টর অ্যান্ড হেলথের কোচ আনিকা রাব্বানী এবং বাংলাদেশ জাতীয় দলের ক্রিকেটার এনামুল হক বিজয়। সঞ্চালনায় ছিলেন ডা. শ্রাবণ্য তৌহিদা। অনুষ্ঠানটি ১৩ মার্চ প্রথম আলো ও এসকেএফের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।

জাতীয় দলের ক্রিকেটার এনামুল হক বিজয়

ক্রিকেটারদের প্রায়ই জয়েন্টের ব্যথায় ভুগতে দেখা যায়। এটি এড়াতে সচেতনতা আর ফিটনেস খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনুষ্ঠানের শুরুতেই এনামুল হক ফিটনেসের জন্য কী করেন, তা–ই জানতে চাওয়া হয়। জবাবে তিনি বলেন, ‘ফিটনেসের জন্য প্রচুর পরিমাণে দৌড়াতে হয়, রিহ্যাব, প্রিহ্যাব করতে হয়। সেই সঙ্গে ডায়েট করা লাগে। এর ভেতর আমার পছন্দ হচ্ছে রানিং করা এবং রিহ্যাব, প্রিহ্যাব করা।’

ফিটনেস হঠাৎ এক দিনে অর্জন করা যায় না। এ জন্য নিয়মিত কাজ বা অনুশীলন করতে হয়। প্রতিদিন ঘরের কাজ করলেও ফিট থাকা যেতে পারে বলে জানালেন আনিকা রাব্বানী। তিনি আরও বলেন, ‘ছোটখাটো কাজ, যেমন ঘুম থেকে উঠে বিছানা গোছানো, হালকা ঝাড়ু দেওয়া যেতে পারে। বাসার এসব কাজ আমাদের হার্টবিট বাড়ায় না। তাই একে ওয়ার্কআউট বলা যায় না। এখন অনেকের বাসায় কাজের লোক থাকে বলে কেউ সহজে বাসার কাজগুলো করেন না। তবে যদি করত, তাহলে ভালো হতো।’
এ দেশে অনেকে ফিট থাকার জন্য যোগব্যায়াম করে থাকেন।

ইয়োগানিকার ইয়োগা ইন্সট্রাক্টর অ্যান্ড হেলথের কোচ আনিকা রাব্বানী

অনেকের আগ্রহ আছে এর প্রতি। এটি শুরু করতে আলাদা মানসিক প্রস্তুতি বা কোনো সেটআপের প্রয়োজন আছে কি না, জানতে চাওয়া হলে আনিকা রাব্বানী বলেন, ‘ইয়োগা একধরনের দক্ষতা। যোগ বলতে শরীর ও মনের একটি সংযোগ বোঝায়। এটি যেকোনো জায়গায় যখন ইচ্ছা করা যায়। ঘরে চেয়ারে বসেও করা যায়। এটি নির্ভর করে মনের ওপর। আপনি আপনার মনকে কতটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন, তার ওপর। মন ও শ্বাসপ্রশ্বাসকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে যেকোনো জায়গায় এটি করা যায়।

আসন কিন্তু যোগব্যায়াম নয়। এটি নিয়ে ভুল ধারণা আছে। যোগব্যায়ামের জন্য মানসিক স্থিতিশীলতা গুরুত্বপূর্ণ।’ ফিটনেসের ক্ষেত্রে ইয়োগার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আনিকা রাব্বানী বলেন, ‘আমি নিজে ইয়োগা করি আর জিমে গিয়ে ওয়েটলিফটিং করি। আমি মনে করি, ক্রস ট্রেইনিং বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অনেক নারী আছে, যারা ওয়েটলিফটিং করতে ভয় পায়। কিন্তু এটি করলে মাসল বেশ মজবুত হয়। আর আমরা সবাই জানি, শক্তিশালী দেহ শক্তিশালী মন গড়ে তোলে, যেটা আমাদের নারীদের জন্য জরুরি। আর ইয়োগা একটি পরিপূরক ব্যায়াম। কারণ, এতে অনেক স্ট্রেচিং আছে। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এর ব্রিদিং টেকনিকগুলো। শ্বাসপ্রশ্বাসের এই কৌশলের মাধ্যমে অনেক অসুখ, এমনকি মানসিক সমস্যাও সেরে যেতে পারে।’

আনিকা রাব্বানীর কথার সঙ্গে একমত হয়ে ডা. কৃষ্ণ প্রিয় দাস বলেন, ‘যোগব্যায়াম করলে অনেক কার্ডিয়াক বা মস্তিষ্কের সমস্যা দূর করা সম্ভব। আর যেকোনো কাজ ভালোভাবে করার জন্য আমাদের একটি শান্তিপূর্ণ একাগ্র মন দরকার। শরীর ঠিক রাখতে শারীরিক ব্যায়ামের সাথে মনের একাগ্রতার জন্য ইয়োগার প্রয়োজন আছে।’
ওজন কমানোর জন্য যোগব্যায়াম খুব একটা কাজের নয়, এমনটা অনেকেই ভেবে থাকেন।

আনিকা রাব্বানী জানালেন অন্যকথা। তিনি বলেন, ‘এটি একটি ভুল ধারণা। অনেক ধরনের ইয়োগা আছে। আমি যে ইয়োগা করি, অষ্টাঙ্গ বিন্যাস একটি অ্যাথলেটিক ইয়োগা। এতে হার্ট রেট অনেক বেড়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে জিমের অনেক টাস্কের চেয়েও এটি কঠিন। ওজন কমানোর জন্য হালকা থেকে এ ধরনের অ্যাথলেটিক ইয়োগা করা যায়। ওজন কমানোর জন্য ৭০ শতাংশ ডায়েট এবং ৩০ শতাংশ ব্যায়াম করতে হবে।’

অনুষ্ঠানে ডা. কৃষ্ণ প্রিয় দাস জয়েন্টের ব্যথার কারণ সম্পর্কে জানান, ব্যথা অনেক কারণে হতে পারে। আঘাতের ফলে, বয়স বেড়ে হাড়ক্ষয় হয়ে গেলে, ইনফেকশন, নিউরোপ্লাস্টিক কন্ডিশন, টিউমার ইত্যাদির কারণে ব্যথা হতে পারে। আঘাতজনিত ব্যথা খুব গুরুতর না হলে চিকিৎসা করালে সহজে সেরে যায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের হ্যান্ড অ্যান্ড রিকনস্ট্রাক্টিভ সার্জারি অর্থোপেডিকস বিভাগের অধ্যাপক কৃষ্ণ প্রিয় দাস

এটি ছাড়া অল্প বয়সে হাঁটুর জয়েন্টে ব্যথা হলে সেটা গুরুত্বসহকারে নিতে হবে। কারণ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যথা টিউমারের জন্য হয়ে থাকে। তাই ২০ বছরের নিচে কারও এমন ব্যথা হলে অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কারণ, আগে টিউমার ধরা পড়লে তা চিকিৎসা করে পা ও জীবন দুটি বাঁচানো সম্ভব। কিন্তু দেরি করে অ্যাডভান্স লেভেলে গেলে পরে আর কিছু করার থাকবে না।

আবার ৪০ বছর পর ক্ষয়জনিত কারণে ব্যথা হয়, যাকে অস্টিও–আর্থ্রাইটিস বলে। এ নিয়ে তিনি আরও বলেন, যে জয়েন্টগুলোতে অনেক বেশি মুভমেন্ট হয়, সেগুলোকে সাইনোভিয়াল জয়েন্ট বলে। বয়সের সঙ্গে এসব জয়েন্টে ক্ষয় হয়। এ জন্য ব্যথা হয়। জয়েন্টের আশপাশের মাসলগুলোতে ইনজুরির জন্য ব্যথা হতে পারে।

জয়েন্ট সুস্থ রাখতে সবার প্রথমে ওজন ঠিক রাখতে হবে। বিএমআই ২০ থেকে ২৫–এর ভেতর থাকতে হবে। এর কমবেশি কোনোটাই ভালো নয়। ব্যায়াম করতে হবে। জয়েন্টের মাসল শক্তিশালী রাখতে কিছু ব্যায়াম আছে, সেগুলো করতে হবে। ক্যালসিয়াম, মিনারেল, ভিটামিন ডি–জাতীয় খাবার, যেমন ছোট ছোট মাছ, কচুশাক, দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার খেতে হবে। ভাত কম খেতে হবে। এভাবে চললে জয়েন্টের ব্যথা প্রতিরোধ করা যাবে বলে জানান ডা. কৃষ্ণ প্রিয় দাস।

এ ছাড়া চিকিৎসা সম্পর্কে বলেন, হালকা ব্যথা হলে প্যারাসিটামলই যথেষ্ট। বেশি ব্যথা হলে কিছু নন-স্টেরয়েড ওষুধ দেওয়া হয়। আর জয়েন্টের ক্ষয়পূরণের জন্য কোলাজেন ইত্যাদি দেওয়া হয়। এর পাশাপাশি ভিটামিন ডি এবং ক্যালসিয়াম প্রেসক্রাইব করা হয় এবং এর সঙ্গে নির্দিষ্ট কিছু ব্যায়ামও দেওয়া হয়। কোনো জয়েন্ট বা হাড়ের ব্যথা ওষুধে একেবারে সারে না।