নিজের গল্প করতে গিয়ে প্রতিবার কেঁদে ফেলি

অ্যাঞ্জেলা লি কানাডীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন মার্শাল আর্টিস্ট। মিশ্র মার্শাল আর্টের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা ‘ওয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে’ সবচেয়ে লম্বা সময় ধরে চ্যাম্পিয়নের খেতাব ধরে রাখার রেকর্ডটি তাঁর। লড়াই যাঁর কাছে খেলা, তিনিও কিন্তু মনের লড়াইয়ে প্রায় হারতে বসেছিলেন। কীভাবে নিজেকে ফিরে পেলেন? প্লেয়ারস ট্রিবিউনে অ্যাঞ্জেলা নিজেই লিখেছেন সেই গল্প।

সন্তানের সঙ্গে অ্যাঞ্জেলা লি
ছবি: সংগৃহীত

আমি অ্যাঞ্জেলা লি। একজন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। একজন লড়াকু। মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে ফেরা একজন মানুষ।

ছয় বছর আগে জীবনটা শেষ করে ফেলতে চেয়েছিলাম। ২০১৭ সালের নভেম্বরে যে গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছিলাম, আদতে সেটা ছিল আত্মহত্যার চেষ্টা।

তখন বয়স ২০। একটা স্বপ্নিল জীবন যাপন করছিলাম। আগের বছরই ওয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ইতিহাসে প্রথম নারী বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব পেয়েছি। নতুন গাড়ি কিনেছি। প্রেমিককে বিয়ে করব বলে প্রস্তুতি নিচ্ছি। বলা যায়, ওটাই ছিল জীবনের সবচেয়ে সুখের সময়।

মনের লড়াই

তারপর এল নভেম্বর। বছরের শেষ ম্যাচটার জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছি, তখনই রাজ্যের চাপ এসে ভর করল। অস্থিরতা, উদ্বেগ, প্রত্যাশার চাপ দিন দিন বাড়তে লাগল। মনে হতে লাগল, পরের ম্যাচের লড়াইটাই জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

এখন পেছনে ফিরে তাকালে মনে হয়, সে সময় আমার সবই ছিল। শুধু আমিই চোখ মেলে দেখিনি। কৃতজ্ঞ বোধ করিনি। কারণ, ওই একটা ম্যাচের কাছে কেন যেন সব তুচ্ছ হয়ে গিয়েছিল। নিজেকে বলতে শুরু করেছিলাম: যদি না পারো, তাহলে সব হারাবে।

একজন ক্রীড়াবিদের মধ্যে এই বোধ থাকা ভালো। এই মানসিকতা একধরনের অনুপ্রেরণা দেয়। কিন্তু একই সঙ্গে এটা অনেকটা দুই দিক ধারালো তলোয়ারের মতো। ফলে আমার শরীর এবং মনের দূরত্ব দিন দিন বাড়ছিল।

যদি খেলায় হেরে যাই, কী হবে, এই ভাবনা মন থেকে তাড়াতে পারছিলাম না কিছুতেই। জীবনে কখনো কোনো প্রতিযোগিতা থেকে পিছপা হইনি, এটাই ভয় পাইয়ে দিচ্ছিল আরও।

কাঁধে হাত

মনে কী চলছে, সবই সারা পৃথিবীর কাছে গোপন রেখেছিলাম। কিন্তু অবশেষে একজনের কাছে মুখ খুললাম। আমার স্বামী, ব্রুনো।

গাড়ি দুর্ঘটনার সময় সে ছিল সিঙ্গাপুরে। খবর পেয়েই ছুটে আসে আমার কাছে। দেখা হতেই বলে, ‘অ্যাঞ্জেলা, কী হয়েছিল? তুমি কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। কী হচ্ছে, বলো তো?’

কেন যেন মনে হলো, একটা কিছু ঠিক নেই, সেটা ব্রুনোও টের পেয়েছে।

আমি ভেঙে পড়লাম। কাঁদতে কাঁদতে বললাম, ‘না। ঘুমিয়ে পড়িনি। কোনো দুর্ঘটনা নয়, ইচ্ছা করেই কাজটা করেছি।’

ব্রুনো যেন একটা ধাক্কা খেল। কিন্তু আমি যে সত্যি কথাটা বলেছি, এটা অন্তত ওকে স্বস্তি দিচ্ছিল। ব্রুনোকে খুব দ্বিধান্বিত দেখাচ্ছিল। কিন্তু যখন সে আমার কাঁধে হাত রাখল, মনে হলো বুকের ভেতর থেকে একটা পাথর নেমে গেছে। এটুকুই আমার বড় দরকার ছিল। ভাগ্যিস, ব্রুনো জানতে চেয়েছিল। ওকে বলার পরপরই আমি নিরাপদ বোধ করতে শুরু করলাম, চারপাশটা ভালোবাসায় ঘিরে গেল।

নিজেকে ফিরে পাওয়া

ধীরে ধীরে আমার ভাঙা মন জোড়া লাগতে শুরু করল। শুরুটা করলাম ছোট ছোট পদক্ষেপে। যেমন যখনই ‘প্যানিক অ্যাটাক’ হতো, নিজের হৃৎস্পন্দন মন দিতাম। ৪ সেকেন্ড ধরে শ্বাস নিতাম, ৭ সেকেন্ড দম আটকে রাখতাম, তারপর ৮ সেকেন্ড ধরে শ্বাস ছাড়তাম। শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক হওয়া পর্যন্ত এটা আমি করতেই থাকতাম।

আরেকটা অভ্যাস আমাকে খুব সাহায্য করেছে, যা এখনো করি। লেখালেখি। নিজের কাছে চিঠি লেখি। মনের ভেতর কী চলছে, কেমন বোধ করছি, এই মুহূর্তে কোন ১০টি কারণে আমার কৃতজ্ঞ বোধ করা উচিত, সব লিখে রাখি। সব সময় যে ১০টা কারণ খুঁজে পাওয়া যায়, তা নয়; কখনো ১টা লিখি, কখনো ৩টা, কখনো ৫টা। এভাবে ১০টা কারণ খুঁজে পাওয়া যায় ঠিকই। এর মধ্য দিয়ে আমার দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে।

আরও পড়ুন

কখনো যদি দিনটা খারাপ যায়, চিন্তা আর আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি; তখন সেই কাজগুলোই করার চেষ্টা করি, যা আমার নিয়ন্ত্রণে আছে। বাইরে যাই। সূর্যের আলো গায়ে মাখি। প্রকৃতির সঙ্গে সময় কাটাই।

আরও একটা উপায় আছে, যেটাকে অনেকেই খুব একটা আমলে নেয় না; তা হলো পশুপাখির সঙ্গে সময় কাটানো। আমি সব সময় কুকুরপ্রেমীদের দলে। কখনো কখনো যখন নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে পারবেন না, এই ছোট্ট লোমশ বন্ধুটির সঙ্গে সময় কাটিয়ে তাঁর ভালোবাসাটুকু অনুভব করার মধ্যেও একধরনের শান্তি খুঁজে পাবেন। মনে বল পাবেন।

এখন মাঝেমধ্যেই নিজেকে একটা ভালো চা বা কফি বানিয়ে খাওয়াই। এ রকম ছোট ছোট কাজের মধ্য দিয়েই একটু একটু করে ভালো বোধ করি। কিসের মধ্য দিয়ে গেছি, এ নিয়ে যত বেশি মানুষের সঙ্গে কথা বলি, তত মনটা হালকা হয়।

হ্যাঁ, মনের উপশম একটা বড় চ্যালেঞ্জ বটে। মোটেই সহজ কাজ নয়। এখনো নিজের গল্প করতে গিয়ে প্রতিবার কেঁদে ফেলি। গলা ভেঙে আসে। কিন্তু প্রতিবারই আগের চেয়ে ভালো বোধ করি।

এটাই জীবন। জীবন মানেই শেখা আর নিজেকে মেনে নেওয়ার মধ্য দিয়ে একটু একটু করে বেড়ে ওঠা। কিছুদিন ভালো যায়, কিছুদিন খারাপ। কিন্তু লড়াই জারি রাখতে হয় প্রতিটি দিন। (সংক্ষেপিত)

ইংরেজি থেকে অনুদিত