গুজব নয়, রাসেলস ভাইপারের সত্য তথ্যগুলো দেখে নিন একনজরে
রাসেলস ভাইপার, বাংলায় চন্দ্রবোড়া। মানুষের মুখে মুখে রাসেল ভাইপার নামে পরিচিত এই সাপ বাংলাদেশে এখন এক আতঙ্ক। সঙ্গে যোগ হয়েছে নানা গুজব।
পৃথিবীতে রাসেলস ভাইপারের দুটি প্রজাতি আছে—
১. Daboia russelii—যার বিস্তৃতি ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কায়।
২. Daboia siamensis—এর বিস্তৃতি চীন, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডে।
এই সাপের ধরন সম্পর্কে আগে একটু জেনে নেওয়া যাক।
স্বভাব: সাধারণত গরমকালে সন্ধ্যা ও রাতে বেশি সক্রিয়, তবে শীতকালে দিনের বেলায় এরা বেশি সক্রিয় থাকে।
বাসস্থান: ফসলি জমি, খোলা ঘাসযুক্ত এলাকা, ঝোপঝাড়, বনের প্রান্ত, পাথুরে টিলা, ঘন কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড় এবং ম্যানগ্রোভ বন ও আশপাশে এর বাস।
খাবার: মূলত ইঁদুরজাতীয় প্রাণী, পাখি, গিরগিটি বা টিকটিকি, ব্যাঙ ও পোকামাকড়।
প্রজননক্ষম: দুই থেকে তিন বছরে।
প্রজননকাল: মে থেকে নভেম্বর। তবে সবচেয়ে বেশি জুন-জুলাইয়ে। যৌনমিলনের পর স্ত্রীরা পেটে নিষিক্ত ডিম ধারণ করে রাখে এবং তা থেকে ৬ মাস পর ৬-৬৩টি বাচ্চা প্রসব করে।
বিষের ধরন: স্নায়ু-পেশি-কিডনি ও রক্তবিনাশী।
বাংলাদেশে গত শতাব্দীতেও রাসেলস ভাইপার ছিল। ১৯৯৫ সালে এই সাপের কামড়ে রাজশাহী জেলার তানোর উপজেলায় এক নারীর মৃত্যু হয়।
২০০২ সাল থেকে এর আনাগোনা একটু বাড়ে। দুটি নমুনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। ২০১৩ সালে রাসেলস ভাইপার দংশনের প্রথম কেস রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আসে। রোগী চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ২০১৩ থেকে ২০২৪ সালের ৭ জুন পর্যন্ত ২৩৫ জন রাসেলস ভাইপার দংশনের রোগী রাজশাহী মেডিকেলে আসে। তাদের মধ্যে মারা যায় ৬৯ জন (২৯.৩৬ শতাংশ)। ২০২৩ সালের জুন মাসের একটি সম্মেলনের অপ্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে বছরে সাড়ে ৭ হাজার মানুষ সর্পদংশনে মারা যায়। এখন পর্যন্ত আনুমানিক ১০০ জন রাসেলস ভাইপারের দংশনে মারা গেছে। তাহলে সাড়ে ৭ হাজারের মধ্যে ১০০ জন—শতাংশের হিসাবে দাঁড়ায় ১.৩৩।
তাহলে রাসেলস ভাইপারের দংশন নিয়ে এত আতঙ্ক ও গুজব কেন?
খারাপ খবর প্রচার হয় বেশি এবং বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে এ খবর বেশি ছড়িয়ে পড়েছে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন মিডিয়া রাসেলস ভাইপারের খবর প্রচারে বেশি আগ্রহ দেখাচ্ছে। এ জন্যই রাসেলস ভাইপার নিয়ে এত আতঙ্ক ও গুজব।
রাসেলস ভাইপারের বিস্তৃতি বাড়ার কারণ
রাসেলস ভাইপারের সংখ্যা বাড়ার প্রকৃত কারণ অনেক। তবে রাজশাহীর বরেন্দ্র অঞ্চলে এর বাড়ার সম্ভাব্য কারণ হলো—
১. নব্বইয়ের দশকের আগে সাধারণত কৃষকেরা বছরে একটি বা কোনো জমিতে দুটি ফসল চাষ করতেন। ফসল চাষের জন্য পানির অভাবে বছরের বাকি সময় জমি পতিত থাকত। সেচ ব্যবস্থার উন্নতির ফলে কৃষকেরা বছরে দুই থেকে তিনটি ফসল চাষ করে আসছেন। জমিতে ফসল কমবেশি সারা বছরই থাকে এবং রাসেলস ভাইপারের প্রধান খাদ্য ইঁদুর ফসলের খেতেই বাস করে। এসব ইঁদুরের গর্তে সাপও বাস করে, তাই ফসলি জমিতে পর্যাপ্ত খাবার পাওয়ার ফলে প্রজননের মাধ্যমে রাসেলস ভাইপারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
২. পতিত ঘাসের জমি ও ঝোপঝাড় সীমিত হওয়ায় সাপগুলো ফসলের ক্ষেতে আশ্রয় নেয়।
৩. চরাঞ্চলে (উদীয়মান ভূমি এলাকায়), বিশেষ করে রাজশাহীর পদ্মার চর এলাকার ফরহাদপুরে বন বিভাগের বনায়ন কর্মসূচির ফলে সেখানে গাছপালার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। সেখানেও রাসেলস ভাইপারের নিরাপদ আশ্রয়স্থল তৈরি হয়েছে। ভারত থেকে বন্যার পানির সঙ্গে কচুরিপানা ভেসে আসে। এই কচুরিপানার সঙ্গে রাসেলস ভাইপারও আসতে পারে।
৪. বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী পশ্চিম বাংলার অনুর্বর ঝোপঝাড় এলাকা আগুনে পুড়িয়ে কৃষিজমিতে রূপান্তরের কারণে কিছু সাপ বাংলাদেশে স্থানান্তর হয়ে থাকতে পারে।
রাসেলস ভাইপার নিয়ে করণীয় কী?
১. ঘাসের ঝোপ ও ঝোপঝাড়ে যেতে হলে প্রথমে ৫-১০ ফুট লাঠি বা বাঁশ দিয়ে নাড়াচাড়া করে তারপর সেখানে যান। পরনে গামবুট ও জিনসের প্যান্ট থাকা ভালো। ফসলি জমিতে কাজ করা বা ফসল কাটার সময় একই পোশাক পরতে পারেন।
২. রাতে চলাচলের সময় টর্চলাইট ব্যবহার করুন।
৩. শোবার ঘরে বস্তায় ফসল রাখবেন না। কারণ, সেখানে পোকামাকড়, টিকটিকি ও ইঁদুর ফসল খেতে আসতে পারে এবং এদের খেতে সাপ আসতে পারে। একই কারণে রাতের খাবারের উচ্ছিষ্টাংশও খোলা রান্নাঘরে বা উঠানে রাখা ঠিক না।
৪. রাসেলস ভাইপার উপদ্রুত এলাকা, বিশেষ করে পদ্মা নদী অববাহিকা অঞ্চলের সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জিনসহ অন্যদের মধ্যেও রাসেলস ভাইপার সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করা দরকার।
৫. রাসেলস ভাইপার বা অন্য কোনো সাপ কামড়ালে আক্রান্ত ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব নিকটস্থ উপজেলা বা জেলা হাসপাতালে নিয়ে যান।
৬. রাসেলস ভাইপারের দংশনে মৃত ব্যক্তির পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা। যেমনটি দেওয়া হয় হাতির আক্রমণে কেউ মারা গেলে। এ ক্ষেত্রে হাসপাতালের চিকিৎসকের দেওয়া সনদই যথেষ্ট।
সরকারি পর্যায়ে যেসব সতর্কতা নেওয়া হয়েছে বা হচ্ছে—
১. রাসেলস ভাইপার উপদ্রুত এলাকার উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অ্যান্টিভেনম সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়েছে।
২. রাসেলস ভাইপার কামড়ালে করণীয়, এ ব্যাপারে উপজেলা পর্যায়ের ডাক্তারদের পরামর্শ ও অ্যান্টিভেনম প্রয়োগের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এক ডোজ অ্যান্টিভেনম প্রয়োগ করে প্রয়োজনে নিকটস্থ জেলা সরকারি হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার জন্য প্রেরণ করার উপদেশও দেওয়া হয়েছে। যার সুফল ইতিমধ্যে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাওয়া গেছে।
৩. বন বিভাগ এ ব্যাপারে বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের সঙ্গে অনলাইনে মিটিংয়ের মাধ্যমে আলোচনা করেছে। রাসেলস ভাইপার উপদ্রুত এলাকায় দ্রুত পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাসও দেওয়া হয়েছে।
লেখক: সাপ বিষয়ক গবেষক