স্যার বলতেন, ‘সৎ থাকলেই হবে, আর কিছুর প্রয়োজন নেই’
গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাট চুকিয়ে ভর্তি হলাম উপজেলার সেরা স্কুলে। কেশবপুর পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজ (বর্তমানে কেশবপুর সরকারি পাইলট উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়) ফলাফলসহ বিভিন্ন সূচকে যশোর বোর্ডে অনেকটাই এগিয়ে। ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণিতে ওঠার পর বন্ধুরা গ্রুপ গ্রুপ করে বিভিন্ন স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে শুরু করল। ইংরেজি পড়ার জন্য মঈন স্যারের কাছে যেতে বললেন বাবা। মো. মঈন উদ্দীন, কেশবপুর পাইলট স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক তিনি। আমাদের যদিও ক্লাস নিতেন না। তারপরও দূর থেকে গম্ভীর মানুষটাকে দেখে কিছু ধারণা তৈরি হয়েছিল মনে। অনেক রাগী, প্রশ্ন করলেই বকবেন ইত্যাদি। তাই বাবাকে বলি, ‘স্যারের কাছে পড়তে যাব না!’ কিন্তু বাবা শুনলেন না। বলা যায়, একপ্রকার বাধ্য হয়েই স্যারের কাছে পড়তে গিয়েছিলাম।
প্রথম যেদিন বাবার সঙ্গে স্যারের বাড়িতে যাই, ভীষণ অবাক হই। গম্ভীর মানুষটার পরনে লুঙ্গি, গায়ে একটা সাদা চাদর। শীতকাল ছিল তখন। চারপাশে শিক্ষার্থীরা বসে আছে। খাতায় লিখে বোঝাচ্ছেন তিনি। বাবা কথা শুরু করতেই স্যার আমার নাম ধরে বললেন, ‘আমার পাশে এসে বোস।’ মুগ্ধ হলাম। আগে বাবার সঙ্গে কথা হওয়ার সময় বাবা আমার নাম বলেছিলেন তাঁকে। আরও ভয় কেটে গেল ক্লাসের কজন সহপাঠীকে দেখে। স্যারের কাছাকাছি পৌঁছানোর বর্ণনা এ পর্যন্তই থাক। এবার স্যারকে নিয়ে বলি।
আজ থেকে ৬০–৭০ বছর আগেও পড়ালেখার মান কত উন্নত ছিল, পড়ালেখা করা কত কঠিন ছিল, তা সবিস্তার বর্ণনা করার প্রয়োজন পড়ে না। তখন পড়ালেখায় ভালো করলে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ দেখতে আসত। মঈন স্যার ছিলেন সেই ভালো ছাত্রদের দলে। আমরা যাঁরা স্যারের ছাত্র, বোধ করি তাদের কেউই স্যারকে কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের শিক্ষক হিসেবে অভিহিত করতে আগ্রহ বোধ করবে না। কোন বিষয়ে জ্ঞান ছিল না তাঁর! ইংরেজি অভিধান ছিল ঠোঁটের আগায়। একটি শব্দ বললে অ্যানাটনিম, সিনোনিমসহ আরও ১০টি শব্দ বলে দিতেন। বলে দিতেন অনেক অর্থও। একইভাবে আমাদেরও শেখাতে চেষ্টা করতেন, শিখতে বলতেন। বিজ্ঞানের নানা বিষয়ও ছিল তাঁর নখদর্পণে। উপপাদ্য বোঝাতেন অভিনবভাবে। ইংরেজি সাহিত্য, বাংলা সাহিত্য প্রতিটি বিষয়ে স্যারের জানাশোনা ছিল। গম্ভীর মানুষটার রসবোধও ছিল দারুণ। গম্ভীর মুখে হাসির কথা বলেছেন আর গোটা বারান্দা হাসিতে ফেটে পড়েনি, কখনো এমন হয়নি।
নতুন কেউ পড়তে এলে কারও কারও কাছে জিজ্ঞেস করতেন, ‘রোল কত? কত রোলের মধ্যে ঢুকতে চাস এবার?’ জবাবে কেউ ১০–এর মধ্যে যেতে চাই বললে, স্যার ‘কীভাবে পারবি! তোর লক্ষ্য যদি ১০ হয়, তবে তোকে সেটা আরও এগিয়ে আনতে হবে; না হলে তো ১০–এ পৌঁছাতে পারবি না।’ বলে মৃদু একটা হাসি দিতেন স্যার।
মঈন স্যারের স্মরণশক্তি ছিল প্রখর। যেকোনো বিষয় গড়গড় করে মুখস্থ বলে দিতে পারতেন। গোটা উপজেলার মানুষ তাঁকে চিনত। শুধু চিনতই–বা বলছি কেন, লেখাপড়া জানা অর্ধেকের বেশি মানুষ তাঁর ছাত্র। স্যার অবসরে যাওয়ার আগে আগে দুই-একটা ক্লাস করারও সৌভাগ্য হয়েছিল আমার, আমাদের। ওই বয়সেও একজন তরুণ শিক্ষকের মতো উচ্ছ্বাস নিয়ে ক্লাস নিতেন তিনি। ক্লাসে আসার পর তাঁর বয়স কমে যেন ২৭-২৮ হয়ে যেত। তাঁর আরেকটি গুণ হচ্ছে, হাতের লেখা। কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা অক্ষরগুলো কাগজে মুক্তার মতো মনে হতো। ব্ল্যাকবোর্ড বা হোয়াইট বোর্ডের লেখা সাধারণত কাগজ-কলমে লেখার মতো হয় না। এখানেও স্যার ছিলেন অনন্য।
স্যারের কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি। ক্লাস সেভেন-এইটে থাকতে স্যারের মুখে শোনা সাহিত্যের নানা বিষয়ে আলোচনা আমাকে প্রভাবিত করেছে। আরও একটা ঘটনা মনে পড়ছে। স্যার তখনো অসুস্থ। তবে হাঁটতে-চলতে পারেন। আমরা তখন কলেজে পড়ি। পলাশ স্যারের ব্যাচ থেকে পিকনিকে যাব। বাজার করার জন্য গাজীর মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। স্যারকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে গেলাম। শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করার পর নানা কথা হলো। একপর্যায়ে স্যার বললেন, ‘গোস্বামী, ভালো আছিস তো? তোর মামাবাড়ি না বাগেরহাট?’
বন্ধুরা স্তম্ভিত। আমার মামাবাড়ি কোথায়, সেটাও স্যারের মনে আছে! জানি না কেন, স্যার আমাকে ভালোবাসতেন। অতুল স্নেহ পেয়েছি তাঁর। স্যার বলতেন, ‘সৎ থাকলেই হবে, আর কিছুর প্রয়োজন নেই। যেটাই করবি, সততার সঙ্গে করবি। পরীক্ষায় নকল করে ভালো কিছু করা যায় না। আজ নকল করছিস, কিছুদিন পর চাকরি করতে গিয়ে ঘুষ খাবি। খারাপ কাজের সঙ্গে যুক্ত হবি।’
এ বছরের জানুয়ারি মাসে স্যার পরলোক গমন করেছেন। অক্টোবরের ৫ তারিখ ছিল শিক্ষক দিবস, আজ তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।