সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম আপনার শরীরে, মনে মারাত্মক প্রভাব ফেলে কীভাবে
বহু বছর আগে হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে খুঁজে পাওয়ার সূত্র হতে পারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। হাজার হাজার মাইল দূরের দেশে বেড়ে উঠতে থাকা নাতি–নাতনিদের ছবিটুকু দেখতে পাওয়ার আনন্দময় মাধ্যমও হয়ে দাঁড়াতে পারে এই প্ল্যাটফর্ম। বিপ্লবের লাল রং উত্তাল ঢেউয়ের মতো ভার্চ্যুয়াল জগতে ছড়িয়ে পড়ার বাস্তব প্রভাব আমরা প্রত্যক্ষ করলাম গত জুলাই-আগস্টের ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে। ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে বাণিজ্যও হচ্ছে। তবে প্রয়োজনের বাইরেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটান বহু মানুষ। যেন সময় কাটানোর এক অবিচ্ছেদ্য মাধ্যম হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। আপাতদৃষ্টিতে নির্বিষ এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম কীভাবে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে, জানেন?
১. ঘাড় এবং চোখের ক্ষতি
ঘাড় নুইয়ে মুঠোফোনে স্ক্রল করতে করতে আপনার ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে। এ ধরনের জটিলতার পোশাকি নাম ‘টেক্সট নেক সিনড্রোম’। এমনকি আপনি যদি ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ কম্পিউটারের সামনে বসে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেন ভুল দেহভঙ্গিতে, তাতেও কিন্তু আপনার ঘাড়ে ব্যথা হওয়ার ঝুঁকি থাকে। কাজের বাইরেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সময় কাটানোর জন্য মুঠোফোন বা কম্পিউটার ব্যবহার করলে ঘাড়ে ব্যথার আশঙ্কা বাড়ে, চোখের ওপর চাপ পড়ে। চোখ শুষ্ক হয়ে পড়তে পারে, চোখব্যথা বা মাথাব্যথা হতে পারে।
২. ঘুম কম, শ্রম কম
অলসভাবে মুঠোফোনে স্ক্রল করতে করতে ঘুমের সঠিক সময়টাও পার করে ফেলেন অনেকে। এভাবে ঘুমের শারীরবৃত্তীয় চক্রে বাঁধা পড়েন। ঘুম থেকে ওঠার পর শরীরটা ঠিক সতেজ অনুভূত হয় না। ফলে সারা দিন একটা বিরক্তি ভাব কাজ করতে পারে নিজের মধ্যে। মেজাজ হয়ে যেতে পারে খিটখিটে।
আবার ডিজিটাল ডিভাইসকেন্দ্রিক সময় যাপনের কারণে এক জায়গায় বসে থাকার প্রবণতা তৈরি হয়। হাঁটাচলা বা খেলাধুলায় যেটুকু পরিশ্রম হওয়ার কথা, সেটুকুও আর হয় না। ফলে মুটিয়ে যাওয়ার প্রবণতাও বাড়ে।
৩. অকারণ দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দুশ্চিন্তারও এক উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে বটে। কারও কারও হয় ‘ফিয়ার অব মিসিং আউট’ (ফোমো)। অর্থাৎ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজের অনুপস্থিতিতে যা ঘটছে, তা ‘মিস’ হয়ে যাওয়ার ভয়। সময়ের সঙ্গে ‘আপডেটেড’ থাকতে না পারার ভয়। এই ব্যক্তিরা এই প্ল্যাটফর্ম থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখতে সমস্যায় পড়েন।
আবার ধরুন, কেউ কোথাও বেড়াতে গেছেন। সেখানকার সৌন্দর্য, খাবারের স্বাদ, এমনকি রোজকার জীবনের বাইরে প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য—সবকিছু নিজে উপভোগ করার চেয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাগ করে নেওয়াটা বেশি ‘জরুরি’ হয়ে দাঁড়াতে পারে কারও কারও কাছে। সব কিছুর ছবি তোলার বাড়াবাড়ি রকমের বাসনা, ছবিতে নিজেকে কেমন দেখাচ্ছে তা নিয়ে অতিরিক্ত ভাবনা—সবটা মিলিয়েই একধরনের অস্থিরতা কাজ করে তাঁদের মধ্যে।
৪. বিষণ্নতার নানা রূপ
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্যের ‘সুখময়’ জীবনছবি দেখে নিজেকে ‘বঞ্চিত’ ভেবে বসতে পারেন কেউ কেউ। কারও ছবি বা ভিডিও দেখে মনে হতে পারে, ‘ও কত সুখী’ বা ‘ও কত সফল’। অথচ বাস্তব জীবন সুখ-দুঃখ মিলিয়েই। চাপা দুঃখ বা গোপন কষ্টের কথাগুলো তো আর কেউ প্রচার করে বেড়ান না। তাই এখান থেকেই শুরু হতে পারে বিষণ্ন দিনযাপন।
‘ওর ছবিতে কত কত রিঅ্যাকশন, আর আমারটায় মাত্র এই কটা!’—এমন তুলনাও মনে হীনম্মন্যতার সৃষ্টি করতে পারে। আবার অন্যের তির্যক মন্তব্যের কারণেও বিষণ্নতায় ভুগতে পারেন কেউ কেউ।
৫. সম্পর্কে জটিলতা
ভার্চ্যুয়াল দুনিয়াকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাস্তবের সম্পর্কের ভিত দুর্বল হয়ে পড়ে কারও কারও ক্ষেত্রে। অনেকের ‘ভার্চ্যুয়াল’ দুনিয়ার আলগা সুখী দাম্পত্য, ঘুরতে যাওয়া, উপহারের বহর দেখেও সঙ্গীর কাছ থেকে সেরকম চাহিদা তৈরি হতে পারে।
তাহলে উপায়?
ভার্চ্যুয়াল দুনিয়া থেকে পুরোপুরিভাবে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলাটা অনেকের জন্য বাস্তবসম্মত সমাধান না-ও হতে পারে। তবে সেখানে নিজের সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারাটা জরুরি। মনে রাখবেন, আপনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যাতে আপনাকে ব্যবহার করতে না পারে। একটা সীমার মধ্যে নিজেই নিজেকে বেঁধে রাখুন, নিজের শারীরিক আর মানসিক সুস্থতার জন্যই।
সূত্র: ওয়েবএমডি