বিয়ের বাজার ডটকম: এক দম্পতির ভিন্ন উদ্যোগ
বিয়ে থেকে শুরু করে জন্মদিন কিংবা যেকোনো করপোরেট আয়োজন—সবই আজকাল মুঠোফোনের অ্যাপ আর কলে ব্যবস্থা করা যাচ্ছে। এক যুগ আগে পরিস্থিতি কিন্তু এমন ছিল না। তখনকার বিয়ের বাজার করতে ছুটতে হতো নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড; দোকানির সঙ্গে চলত বিয়ের ডালা আর সাজসরঞ্জাম নিয়ে দর-কষাকষি, নানা বাহাস। সেই সময়েই অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘বিয়ের বাজার ডটকম’ চালু করেন দুই তরুণ—চন্দ্রনাথ মজুমদার ও কল্যাণী দেবনাথ।
সেটা ছিল ২০০৩ সাল। একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায়ে প্রশাসন নিয়ে পড়ছিলেন চন্দ্রনাথ মজুমদার। মা–বাবার প্রত্যাশা ছিল, লেখাপড়া শেষ করে চাকরি করবে সন্তান। নিজের মতো করে কিছু করার ভাবনা থেকে চন্দ্রনাথ শুরু করেন প্রযুক্তি নিয়ে ব্যবসা। প্রযুক্তি ব্যবসা তখন আজকের মতো ছিল না। কম্পিউটার, প্রযুক্তিই–বা ব্যবহার করতেন কয়জন। তারপরও কাজটি করে যান চন্দ্রনাথ। ২০০৭-০৮ সাল থেকে বাংলাদেশে ফেসবুকের যুগ শুরু হলে অনলাইন ও ডিজিটাল দুনিয়ায় কাজ শুরু করেন চন্দ্রনাথ। অনলাইন ও অফলাইনে করপোরেট ইভেন্টের আয়োজন করতে থাকেন। গ্রাহকের চাহিদা বুঝে ধীরে ধীরে বড় বড় কাজ করা শুরু করেন। চন্দ্রনাথ জানান, ‘প্রযুক্তি ব্যবসা ও ইভেন্ট আয়োজন ভালোই চলছিল। এরই মধ্যে নতুন বুদ্ধি হিসেবে বিয়ের বাজারের কথা মাথায় আসে। সেই লক্ষ্যে ২০১২ সালে চালু করি “বিয়ের বাজার”। বাঙালি বিয়ের আয়োজনে কনে দেখা থেকে শুরু করে অতিথি আপ্যায়ন, ছবি তোলা, রান্না—কত অনুষ্ঠানই তো থাকে। মেহেদির আলাদা অনুষ্ঠান, গায়েহলুদ, বিয়ের অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এক প্ল্যাটফর্মে এখন বাংলাদেশেই মিলছে বিয়ের মতো সামাজিক অনুষ্ঠানের সব অনুষঙ্গ।’
বিয়ের বাজার দিয়েই বিয়ের গল্প
যে সময় বিয়ের বাজার ডটকম চালু করেন চন্দ্রনাথ, তখন অনলাইনে কেনাকাটা করাটা এখনকার মতো গোছানো ছিল না। মোবাইল ব্যাংকিং সেবা কিংবা প্রযুক্তির অন্যান্য সুযোগ মাত্র আসতে শুরু করেছে। কাজের পরিধি বুঝে দল বড় করেন চন্দ্রনাথ। এ সময় তাঁর দলে যুক্ত হন কল্যাণী দেবনাথ। কল্যাণী ও চন্দ্রনাথ দুজনেরই গ্রামের বাড়ি নোয়াখালী, এলাকার সম্পর্কে পরিচিত। ২০১২ সালের পর দুজনে ছোট ছোট অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমে বিয়ের বাজারের কাজের পরিধি বাড়াতে থাকেন। দেশের মানুষের বিয়ে ও সামাজিক জীবনের নানা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও আয়োজনের সবকিছু নিয়ে কাজ শুরু করেন চন্দ্রনাথ মজুমদার ও কল্যাণী দেবনাথ। শৈশব ও কৈশোর থেকেই সৃজনশীল কাজে আগ্রহী ছিলেন কল্যাণী। একসঙ্গে কাজ করতে করতেই ২০১৫ সালে সাতপাকে বাঁধা পড়েন তাঁরা। এখন দুজনেই সফলভাবে এগিয়ে নিচ্ছেন বিয়ের বাজার ডটকম।
ছোট থেকে বড়
এক হাজারের বেশি বিয়ে, জন্মদিনের অনুষ্ঠানসহ নানা ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা করেছে বিয়ের বাজার ডটকম। https://biyerbazaar.com ওয়েবসাইট থেকে গ্রাহকেরা বিয়ে, জন্মদিন, করপোরেটসহ যেকোনো অনুষ্ঠানের জন্য সহায়তা নিতে পারেন। ভেন্যু বুকিং থেকে শুরু করে ফটোগ্রাফি, মেকআপ কিংবা সাজানোর সব সমাধান মিলবে। চন্দ্রনাথ বলেন, ‘শুরুর দিকে করপোরেট ইভেন্টের মাধ্যমে আমাদের নাম-পরিচিতি সবার কাছে পৌঁছাতে থাকে। তখন তো বিয়ের আয়োজন মানেই হল বা অডিটরিয়াম–কেন্দ্রিক ছিল, যে কারণে ছোট ছোট আয়োজনের মাধ্যমে কাজ শুরু করি। মনে পড়ে, প্রথম বিয়ের আয়োজন বেশ ছোট আকারের ছিল। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে আমরা ভিন্নভাবে মঞ্চ আর হল সাজিয়ে সবার মন কেড়ে নিয়েছিলাম। বিয়ের আসরেই কয়েকজন আমাদের ভিজিটিং কার্ড সংগ্রহ করে, পরে যোগাযোগ করেন। ধীরে ধীরে বড় সব আয়োজনে যুক্ত হয়েছি।’
বর্তমানে তাঁদের প্রতিষ্ঠানে দেড় শর বেশি কর্মী কাজ করছেন। দেশের সব জেলার যেকোনো ধরনের বিয়ের আয়োজনেই যুক্ত থাকেন কল্যাণী। তিনি বলেন, ‘আমরা সব ধরনের বিয়ে ও সামাজিক আয়োজনের নিত্য অনুষঙ্গের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে কাজ করছি। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য যা যা প্রয়োজন, তা নিয়ে আমরা হাজির। হল বা ভেন্যু বুকিং থেকে শুরু করে কনে সাজানো বা স্যালন সেবার মতো সবকিছুই প্রদান করছি। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে আমাদের বিশেষায়িত স্যালনে মেকআপের সব সেবা নেওয়ার সুযোগ আছে।
স্বল্প পুঁজি আর সাহস
চন্দ্রনাথ মজুমদার প্রযুক্তি ব্যবসা থেকে জমানো কিছু টাকা আর সাহস নিয়ে শুরু করেন বিয়ের বাজার ডটকম। তখন যেহেতু বাংলাদেশে অনলাইন মার্কেটপ্লেসের বিকাশ মাত্র ঘটছিল। লেগে থাকেন চন্দ্রনাথ মজুমদার। মানুষ যত ইন্টারনেটনির্ভর জীবনে অভ্যস্ত হচ্ছে, ততই চন্দ্রনাথ ও কল্যাণীর কাজের পরিধি বাড়ছে। কল্যাণী বলেন, ‘যে কারও জীবনেই বিয়ে বড় একটি ঘটনা। এই বিয়ের স্মৃতি আজীবন তার মনে গেঁথে থাকে। বাঙালি বিয়ে মানেই যেন বারো রকমের আয়োজন। সব আয়োজনে আমরা গ্রাহকের সব সমস্যার সমাধান দিই। গ্রাহকের বিয়ের পরিকল্পনার শুরু থেকে শেষটা গুছিয়ে দিই আমরা। সর্বোচ্চ পেশাদার ভাবনা নিয়ে সৃজনশীল উপায়ে কাজ করে যাচ্ছি আমরা।
২০ হাজারের বেশি অতিথিকে নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান পরিচালনার রেকর্ডও তাঁদের আছে। আবার সম্প্রতি ভিন্ন ধরনের একটি বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেও আনন্দ পেয়েছেন এই দুই কর্মকর্তা। কনে-বরের ইচ্ছায় পুরো বিয়েতে ছিল কাঁচা ফুলের আয়োজন। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কাঁচা ফুলের ব্যবস্থা করা বা কাঁচা ফুল দিয়ে একটি অনুষ্ঠান আয়োজন করা কঠিন কাজ। পুরো অনুষ্ঠানটি সফলভাবে সম্পন্ন করতে পেরেছিলেন তাঁরা।
চন্দ্রনাথ বলেন, ‘এ বছর থেকেই প্রবাসী বাঙালি ও দেশের বাইরের বিভিন্ন আয়োজনে কাজ করা শুরু করেছি আমরা।’ তরুণেরা এখন ভিন্নমাত্রার অনুষ্ঠানের দিকে ঝুঁকছে। ডেসটিনেশন বিয়ের চল দেখা যাচ্ছে। তারুণ্যের আগ্রহ ও গ্রাহকের ভাবনাকে গুরুত্ব দিয়েই বিয়ের বাজারে নিজেদের অবস্থানকে দৃঢ় করার চেষ্টা করছেন কল্যাণী ও চন্দ্রনাথ।