গান শুনে কোন কোন রোগ ভালো হয়, জানেন?
রোগ হলে আমরা চিকিৎসকের কাছে যাই। তিনি রোগ বুঝে ওষুধ লিখে দেন, আর সেটা খেয়ে সুস্থ হয়ে উঠি। তবে কোনো কোনো রোগে মুখে খাওয়ার ওষুধের চেয়ে কানে খাওয়ার (পড়ুন শোনার) ওষুধ বেশি কার্যকর। কানে খাওয়ার সেই ওষুধের নাম মিউজিক বা সংগীত, যা আমাদের নানা ধরনের অসুস্থতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে।
সংগীত চিকিৎসা কী
আমাদের ভারবাল মেমোরির চেয়ে মিউজিক্যাল মেমোরি অনেক বেশি স্থায়ী। আর এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়েই সংগীতের মাধ্যমে নানা ধরনের রোগের চিকিৎসা করা হয়। সুর–তরঙ্গের মাধ্যমে নিস্তেজ স্নায়ুকে জাগিয়ে তোলার মাধ্যমে রোগ সারিয়ে তোলাই মিউজিক থেরাপির মূলকথা। সুর আর কথার গুণে শরীরে হ্যাপি হরমোনের মতো বিশেষ কিছু হরমোন সক্রিয় হয়ে ওঠে, যার দরুন রোগী সুস্থ বোধ করেন।
১৯৪৫ সালে মার্কিন সমর বিভাগের মাধ্যমে সামরিক সদস্যদের প্রথম এই চিকিৎসা দেওয়া হয়েছিল; যা সে সময় সামরিক সদস্যদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চাঙা হতে সাহায্য করেছিল। এর পর থেকেই মিউজিক থেরাপি বিস্তৃত হতে শুরু করে।
গান শোনা, গীত রচনা, গাওয়া ও বাদ্যযন্ত্র বাজানোর মতো বিষয়গুলো এই থেরাপির অন্তর্ভুক্ত। এই থেরাপিতে অংশ নিতে রোগীকে সংগীত বা বাদ্যযন্ত্রে দক্ষ হওয়ার দরকার পড়ে না।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ডা. তাইয়েব ইবনে জাহাঙ্গীর বলেন, ‘মিউজিক থেরাপি যেকোনো মানুষকে মানসিক, শারীরিক, আধ্যাত্মিক, জ্ঞানগত এবং সামাজিকভাবে সাহায্য করতে পারে। হার্টের সমস্যা, বিষণ্নতা, অটিজম, মাদকাসক্তি এবং আলঝেইমারসহ বিভিন্ন রোগের দাওয়াই হিসেবে সংগীত ক্ষেত্রবিশেষে দারুণ কার্যকর। স্মৃতিশক্তি বাড়াতেও এটি কার্যকর। রক্তচাপ, মানসিক চাপ, দীর্ঘমেয়াদি ব্যথার মতো আরও নানা সমস্যার সমাধানে কাজ করে মিউজিক।’
যেসব রোগে মিউজিক থেরাপি
মিউজিক থেরাপি সব বয়সের জন্যই কার্যকর। শিশু থেকে প্রবীণ—সবাইকেই নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধানে সংগীতের মাধ্যমে থেরাপি দেওয়া যায়।
অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডার আক্রান্তরা এই সেবা নিতে পারেন। অটিস্টিক শিশুদের যোগাযোগ উন্নত করতে সাহায্য করে সংগীত।
স্মৃতিভ্রংশ, আলঝেইমার রোগের চিকিংসায় মিউজিক থেরাপি কার্যকর। এই থেরাপি তাঁদের স্মৃতিশক্তিকে উন্নত ও মনকে উদ্দীপিত করে। সুরের মাধ্যমে ভুলে যাওয়া বিষয়গুলো তাঁরা চমৎকারভাবে মনে রাখতে পারেন। পারকিনসনসে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মোটর ফাংশন উন্নত করতে সহায়তা করে। মিউজিক থেরাপির মাধ্যমে কোমায় চলে যাওয়া অনেক রোগীকেও ফিরে আসতে দেখা গেছে।
সংশোধনমূলক ব্যবস্থাপনায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের চিকিৎসায় সংগীত ভালো উপায়। যেমন বন্দী কিংবা মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন প্রক্রিয়ায় দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে সুর।
যাঁরা ট্রমা ও সংকটের মধ্যে আছেন, তাঁদের উদ্বেগ, চাপ এবং ব্যথা কমাতে পারে মিউজিক থেরাপি।
মাথাব্যথা, অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগ, ক্যানসারে যথাযথভাবে ব্যবহার করা গেলে মিউজিক থেরাপি কার্যকর হতে পারে।
মানসিক ব্যাধিযুক্ত ব্যক্তিরা গানের মাধ্যমে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় মিউজিক থেরাপি টনিকের মতো কাজ করে। আপনার চিন্তাভাবনা ও অনুভূতিগুলোকে ভিন্নভাবে খুঁজে পেতে সাহায্য করবে ভালো কোনো গান বা যন্ত্রের সুর।
দীর্ঘস্থায়ী ব্যথায় আক্রান্ত ব্যক্তির ব্যথা, উদ্বেগ, ক্লান্তি ও বিষণ্নতা কমাতে সাহায্য করে মিউজিক থেরাপি। অপারেশন টেবিলেও তাই আজকাল রোগী বা চিকিৎসককে গাইতে শোনা যায়।
মিউজিক থেরাপি শিশু–কিশোরদের আচরণেও পরিবর্তন ঘটাতে পারে। তাই ছোটদের মেজাজ ও উদ্বেগজনিত ব্যাধি, মনোযোগের ঘাটতি, হাইপারঅ্যাকটিভিটি ডিজঅর্ডারে এসব থেরাপি দেওয়া হয়।
কোথায় মেলে থেরাপি
আমাদের দেশে এখনো শুধু মিউজিক থেরাপি দেওয়ার মতো আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তবে হাসপাতাল, স্কুল, নার্সিং হোম, ক্লিনিক, মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্র এবং উন্নয়নমূলক প্রতিবন্ধী কেন্দ্রের কোথাও কোথাও এটির ব্যবহার চোখে পড়ে। ব্যক্তিগত অনুশীলনের মাধ্যমেও এই থেরাপি দেওয়া যায়।
মূলত দুই উপায়ে মিউজিক থেরাপি দেওয়া হয়। এক. গান বা কোনো সুর শুনিয়ে; দুই. রোগীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে।
প্রথম ধরনটি প্যাসিভ মিউজিক থেরাপির মধ্যে পড়ে। এখানে রোগীর এমন কোনো সমস্যা আছে, যাতে শোনা ছাড়া গতি নেই। যেমন কোমায় থাকা রোগী, যার মস্তিষ্ক আংশিক অকার্যকর অথবা পঙ্গু ব্যক্তি। এ ধরনের পরিস্থিতিতে শোনা ছাড়া সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ থাকে না।
আর দ্বিতীয়টিতে রোগী নিজেও অংশ নিতে পারেন। তাই এ ধরনটি অ্যাকটিভ মিউজিক থেরাপি নামে পরিচিত। যেখানে থেরাপিস্ট হয়তো কোনো গান গাইছেন আর তার সঙ্গে হাত-পা নেড়ে, নেচে কিংবা বাজনার মাধ্যমে তাল দেওয়ার চেষ্টা করছেন রোগী। প্রথম ধরনটিতে যে কেউ যেকোনোভাবে অংশ নিতে পারেন। তবে দ্বিতীয় ধরনে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত থেরাপিস্টের দরকার পড়ে।
একটি বিষয় এখানে বলে রাখা ভালো, যিনি মিউজিক থেরাপি দেবেন, তাকে অবশ্যই রোগীর ‘কেস হিস্ট্রি’ জানতে হবে। কোন ধরনের গান রোগী শুনতে ভালোবাসেন, সেটাও জানা জরুরি। যিনি ভাওয়াইয়া শুনে অভ্যস্ত, তাকে রক শোনালে কোনো লাভ হবে না।
মিউজিক থেরাপির অন্য প্রয়োগ
১. আবেগপ্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। অবদমিত আবেগকে মুক্ত করে দিতে পারে সংগীত। সংগীত বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি কমাতে পারে। বিষণ্নতা ও উদ্বেগকে কমিয়ে মেজাজ ফুরফুরে করতে সাহায্য করে।
২. সংগীত আপনার হৃৎস্পন্দন পরিবর্তন করে। রক্তচাপ ও শ্বাসপ্রশ্বাসের হার কমিয়ে শরীরকে প্রভাবিত করে। শরীর শিথিল করে ঘুম উন্নত করে। সচেতন বা অচেতন শরীরের নড়াচড়াকে উদ্দীপিত করতে সাহায্য করে।
৩. সংগীত আধ্যাত্মিকতার দরজা খুলে দিতে পারে। নিজের ও পরিবারের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসগুলো অনুসন্ধান করার সুযোগ তৈরি করে।
৪. পড়াশোনার ক্ষেত্রেও মিউজিক থেরাপির ব্যবহার চোখে পড়ে। কোনো বিষয় সুরে সুরে বা ছন্দে ছন্দে পড়লে সেটা মনে রাখা সহজ হয়। তাৎক্ষণিক শোনা কিছুকে মনে রাখার ক্ষমতা বৃদ্ধি করে।
৫. সংগীত মানুষকে সামাজিকভাবে একত্রিত করে। শুধু পার্টি, বিবাহ বা অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার মতো বৃহৎ জমায়েতই নয়, হাসপাতালের মতো জায়গাতেও সংগীতের ভূমিকা প্রবল।
সবশেষে বলি, ট্যাবলেট বা তরল ওষুধ খাওয়ার মতো বিড়ম্বনা ছাড়া যদি রোগ সারিয়ে তোলা যায়, তাহলে সেটাই কি ভালো উপায় না!