মানবসভ্যতার উন্মেষের সঙ্গে বন্ধু হয়ে আছে প্রকৃতি। পৃথিবী জীববৈচিত্র্যের রক্ষায় রাখছে রক্ষকের ভূমিকা। হচ্ছে প্রেরণার নিরন্তর উৎস। সৃজনশীল ব্যক্তিরা প্রকৃতি থেকে খুঁজে নিচ্ছেন সৃজনের নানা আকর, উদ্ভাবনের উপাচার। এমনকি এই প্রকৃতিকে মানুষ যেমন বিনষ্ট করছে, তেমনি তাকে রক্ষার জন্য এগিয়ে আসছে।
ফ্যাশন ডিজাইনরাও এর বাইরে নয়। প্রকৃতি বারংবার তাদের সৃষ্টির উদ্দীপনা যেমন হয়েছে, তেমনি এই প্রকৃতিকে নিয়ে ভাবছেও। খুঁজে ফিরছে প্রকৃতিবান্ধব উপকরণ। এমনকি তাদের সৃষ্টিকর্মের মধ্যে দিয়ে প্রতিফলিত হচ্ছে তাদের ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি আর প্রকৃতির প্রতি অনুরাগ।
তরুণ ডিজাইনার রোকাইয়া আহমেদের কাজেও মেলে প্রকৃতির প্রতি অপার ভালোবাসা। সম্প্রতি তাঁর করা এই সময়ের উপযোগী সংগ্রহের তিনি প্রকৃতির এই সৌন্দর্যকে উপজীব্য করেছেন। রোকাইয়া এটা প্রি-ফল আর ফল কালেকশন বা হেমন্ত-শীত সংগ্রহ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন।
প্রিন্ট এখন সব মৌসুমেই আদৃত। অলংকরণের উপাদান হিসেবে বিভিন্ন ধরনের প্রকৃতিপ্রাণিত মোটিফ ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে বিষয়টি তাঁর ভাবনাকে উসকে দিয়েছে। এ ছাড়া করোনাকালে আমাদের মধ্যেও অনেক পরিবর্তন এসেছে। প্রকৃতির প্রতি আমাদের মনোভাব বদলেছে। পরিবেশ আর জীববৈচিত্র্য নিয়ে নতুন করে ভাবতে শিখছি। এটাও তাঁর ডিজাইনের প্রভাবক হয়েছে।
এ ছাড়া ব্রিটিশ ফ্যাশন ডিজাইনার স্টেলা ম্যাকার্টনি প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য নিয়ে কাজ করেন, যেখানে থাকে পরিবেশবান্ধব বিষয়। ব্যালাঁসিয়াগায় কাজেও প্রতীয়মান হয় জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। উদাহরণ এমন আছে আরও। তাঁদের মতোই প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ফুটে উঠেছে তরুণ ফ্যাশন ডিজাইনার রোকাইয়া আহমেদের এই সংগ্রহে।
বিশ্বজুড়ে কেবল ডিজাইনাররাই প্রকৃতি নিয়ে ভাবছেন, তা নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন অনেকে শিল্পীই। এমনকি উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলের কারুশিল্পীরাও রয়েছেন এই দলে। বিষয়টিই উদ্বুদ্ধ করেছে রোকাইয়ার এই সংগ্রহ তৈরিতে। কেবল এটাই নয়, তরুণ এই ফ্যাশন ডিজাইনার সচেতনভাবেই এই থিমকে আগামীর কাজেও অনুঘটক হিসেবে মাথায় রাখছেন।
উপরন্তু তিনি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটকে মিলিয়েছেন বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের সঙ্গে। তাই তো সুন্দরবন আর আমাজনের সমস্যা অভিন্ন হয়ে উঠেছে তাঁর কাপড় ক্যানভাসে। এভাবেই তিনি ভুবনপুরের পথিক হয়ে উঠতে চেয়েছেন।
এই সংগ্রহ তৈরি করতে রোকাইয়া ব্যবহার করেছেন খাদি, মেশিনে বোনা সুতি কাপড়। ভ্যালু অ্যাডিশনের জন্য তিনি বেছে নেন মনিপুরি থামি। এই জাতিগোষ্ঠীর কাপড়ও বিশেষ বার্তাবহ। ভবিষ্যতে তাদের শিল্পকর্মকে বিশেষভাবে তুলে ধরার চেষ্টা, তাদের পাশে দাঁড়ানোর, উদ্বুদ্ধ করার ইচ্ছা তিনি পোষণ করেন।
মোট ছয় সেট পোশাক তিনি বানিয়েছেন। এর মধ্যে রয়েছে ব্লেজার, ওভারকোট, প্যান্ট, ড্রেস, জাম্পস্যুট আর ফিউশন জাম্পসুট। এই ফিউশন জাম্পস্যুটে তিনি ধুতি আর টপকে মিলিয়েছেন। বাঘ, দোয়েল, ফুল, লতা—এসবই মোটিফ হয়েছে তাঁর জেমিন অলংকরণে। এগুলো তিনি ডিজিটাল প্রিন্ট করিয়েছেন। বিশেষ করে খাদির ওপর ডিজিটাল প্রিন্ট অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য নিরীক্ষা।
হালকা ও গাঢ় অফহোয়াইট জমিনেই ডিজিটাল প্রিন্টে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে মোটিফ। সেমিফরমাল পোশাকে ট্রেন্ডিং স্টেটমেন্ট কলার, চল্লিশ দশকের স্টাইলকে প্রকৃতির ছন্দের সঙ্গে মেলানো হয়েছে। কোনো কোনো পোশাকে তিনি পাফ হাতা ব্যবহার করেছেন। এই পোশাক উজ্জ্বল তারুণ্যের উচ্ছ্বাস। তরুণেরা অনায়াসেই পরতে পারবে এবারের শীতে। এই পোশাকের সঙ্গে অনুষঙ্গ হয়েছে হাতে তৈরি গয়না ও ব্যাগ।
প্রিন্টের নান্দনিকতার সঙ্গে কাট ও প্যাটার্নের সঠিক সন্নিবেশে পোশাকগুলো হয়েছে দৃষ্টিনন্দন। প্রাকৃতিক তন্তু দিয়ে তৈরি কাপড়ে ডিজিটাল প্রিন্টে ফুটে ওঠা মোটিফের নানা রং দারুণ আবহের সৃষ্টি করেছে। সবুজের সঙ্গে অন্য সব রং তো আছেই, বিশেষ করে পার্পল আর গাঢ় থামির ব্যবহার বর্ণবৈচিত্র্যে মাত্রা যোগ করেছে।
এই সেমিফরমাল ডিজাইনার ড্রেস যেকোনো তরুণ বা তরুণীর ব্যক্তিগত স্টাইলের সঙ্গে চমৎকারভাবে মানিয়ে যাবে। এই হেমন্তে যেমন পরা যাবে রোকাইয়ার প্রকৃতপ্রাণিত এই পোশাক, তেমনি পার করে দিতে পারবেন পুরো শীত।