ব্লাউজ এল কীভাবে

একসময় ব্লাউজ ছাড়াই পরা হতো শাড়ি। সেলাইবিহীন পোশাক থেকে সেলাই করা পোশাক হয়ে ওঠার গল্পটা কম চিত্তাকর্ষক নয়। আপাতসাধারণ এই পোশাকের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস রয়েছে, যার পরতে পরতে লুকানো আছে সামাজিক রীতিনীতি আর সেই সময়ের মনমানসিকতা। ব্লাউজের সেই ইতিহাসই জানাচ্ছেন রয়া মুনতাসীর

শাড়ির রঙের সঙ্গে না মিলিয়ে ব্লাউজ পরাটাও একটা স্টাইল। হল্টারনেক স্টাইলের এই ব্লাউজে মেশিন এমব্রয়ডারি করা হয়েছে। পুরো ব্লাউজেই কাজ আছে। আবার দুলেও চলে গেছে ব্লাউজের কাজের রং। মডেল: মৃদুলা, ব্লাউজ: স্টাইল ইম্প্রেশন, শাড়ি: টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির
ছবি: সুমন ইউসুফ

মৌর্য আমলের (প্রায় ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ) ভাস্কর্যগুলোতে নারীদের শরীরের নিচের অংশে একটি সেলাইবিহীন কাপড় এবং ওপরে একটি ঢিলেঢালা কাপড়ের টুকরা চোখে পড়ে, যেটা দিয়ে স্তন ঢেকে রাখা হতো। পাশাপাশি ছিল নানা ধরনের অলংকার। চতুর্দশ শতাব্দীর বিজয়নগর সাম্রাজ্যে নারীদের ফ্যাশনে প্রাধান্য পেয়েছিল কঞ্চুকা। শরীরের ওপরের অংশের সঙ্গে আঁটসাঁটভাবে লাগানো ব্লাউজের মতো একটি পোশাক। বিশেষ দরজিরা এটি তৈরি করতেন। তবে পুরো ভারতবর্ষে প্রচলিত মেয়েদের মান পোশাক এটা ছিল না। কারণ, অন্যান্য অঞ্চলে ব্লাউজ ব্যাপকভাবে স্বীকৃত কোনো পোশাক ছিল না।

ভারতে মোগলদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে নারীরা পর্দা সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হন। এই যুগের চিত্রকর্মগুলোতে সালোয়ার-কামিজ এবং ঘোমটা পরা নারীদের দেখা যায়। পাশাপাশি ভারতের দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশে পর্তুগিজদের প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক প্রভাব ধীরে ধীরে প্রবেশ করে।

হাতাকাটা ব্লাউজের পুরোটাতেই চুমকির কাজ। ব্লাউজের কাজে ছোট বিষয়গুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্লাউজে চিকন করে লাগানো হলুদ রঙের পাইপিংয়ের কারণেই চলে এসেছে ভিন্নতা। মডেল: মৃত্তিকা, ব্লাউজ: স্টাইল ইম্প্রেশন, শাড়ি: টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির, সাজ: পারসোনা
ছবি: প্রথম আলো

কাংড়া এবং রাজপুত ধাঁচের চিত্রকর্মগুলোতে সেলাই করা ব্লাউজের সঙ্গে চওড়া স্কার্ট বা ঘাগরা পরা নারীও আছে। এই ব্লাউজগুলো মধ্যযুগীয় এবং মোগল আমলের তুলনায় আলাদা ছিল। রঙিন অলংকৃত এই ব্লাউজগুলো ধনী ব্যবসায়ী এবং জমিদার পরিবারের নারীরাই মূলত পরতে পারতেন।

আঠারো শতকে ব্রিটিশরাজের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে শাড়ি ও ব্লাউজের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা যায়। নারীরা ভিক্টোরিয়ান ধাঁচের ফ্রিল, ফিতা, ব্রোচ ব্যবহার করেন ব্লাউজের ওপর। জনপ্রিয় হয়ে ওঠে উঁচু কলার ব্লাউজ। লেইস দিয়ে তৈরি হাতাও ব্রিটিশ ফ্যাশন ধারা দ্বারা প্রভাবিত ছিল।

স্টাইলের কারণে কলার দেওয়া ব্লাউজও জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। জামদানি শাড়ির সঙ্গে এই ফুলহাতা ব্লাউজের পুরোটাই লেইস জোড়া দিয়ে বানানো। ব্লাউজ: স্টাইল ইম্প্রেশন, শাড়ি: টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির
ছবি: প্রথম আলো

ঠাকুরবাড়ির নারীরা

শাড়ি পরার পুরোনো ধারণাকে নতুন রূপ দিয়েছিলেন ঠাকুর পরিবারের বউ জ্ঞানদানন্দিনী দেবী। পার্সি স্টাইলের দ্বারা ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে বদলে ফেলেন নিজের শাড়ি পরার ধরন। মাঝখানে ঝরঝরে প্লিটসহ শাড়ির স্টাইল করেছিলেন এবং উঁচু কলার, ফ্রিল ও অলংকরণযুক্ত ব্রোচসহ ব্লাউজ পরার স্টাইলটি তিনিই দেখিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন
সিল্কের ব্লাউজের ওপর জারদৌসির কাজ। জমকালো যেকোনো শাড়ির সঙ্গেই মানিয়ে যাবে। ঈদের দিন একটু কারুকাজের এমন ব্লাউজ আপনার সাজে আনতে পারে ভিন্নতা। ব্লাউজ: সাফিয়া সাথী, শাড়ি: টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির
ছবি: প্রথম আলো

ব্লাউজের বিবর্তন

ভারতীয়-হাঙ্গেরিয়ান চিত্রশিল্পী অমৃতা শের-গিল গত শতকের ত্রিশের দশকেই শাড়ির সঙ্গে বেছে নিয়েছিলেন স্লিভলেস ব্লাউজ। ফুলহাতা বা হাফহাতা ব্লাউজের ধারাকে উপেক্ষা করতেই যেন এই সাহসী পদক্ষেপ। ব্লাউজের নকশা বদলে ভারতীয় সিনেমাও একটি ভূমিকা রাখে এই সময়। ১৯৬০ থেকে ১৯৭০ সালের মধ্যে ব্লাউজের নকশা বদলে বিশেষ ভূমিকা রাখে সিনেমা। সিল্ক ও সুতির মতো উপকরণগুলো ব্লাউজে বেশি ব্যবহার করা হলেও স্টেটমেন্ট ব্লাউজের নকশা পরিচিতি পেতে থাকে। 

১৯৬০ ও ১৯৭০–এর দশকে ভারত–বাংলাদেশের ব্লাউজের ডিজাইনগুলো ছিল অনেক সাহসী আর খোলামেলা। বোট নেকের প্রচলনও তখনই দেখা যায়। ’৮০ সালের শুরু থেকে নিচু কাটের গলার নকশা দেখা যেতে শুরু করে। ফ্যাশনে চলে আসে ক্যাপ হাতা আর পিঠখোলা ব্লাউজ।

এই সময়ের ব্লাউজ

টি-শার্টকে যে ব্লাউজ হিসেবে পরা হবে, এটা কি কেউ কখনো চিন্তা করেছিল! এখানেই ফ্যাশনের মজা। একই পোশাককে কত স্টাইলেই–না পরা যায়। আজকাল মাইক্রো ব্লাউজ থেকে শুরু করে ব্রালেট ব্রাউজ, ক্রপটপ থেকে শুরু করে পিঠখোলা ব্লাউজের ওপর করা হচ্ছে নানা নকশা। ব্লাউজে নকশিকাঁথার কাজ, টাই-ডাইয়ের নকশা, অ্যাপ্লিকের কাজ, ব্লকের কাজগুলোও বেশ নজর কাড়ছে।

সূত্র: হাটস অ্যান্ড লুমস ডটকম, উষা ফাউন্ডেশন, এইমস এক্সিবিশন