বউ মানে কি শুধুই লাল
বিয়েতে অনেক কনেকেই আজকাল গাউন বা লেহেঙ্গায় দেখা যায়। তবে কনের পোশাক হিসেবে শাড়ির কদর এখনো সবচেয়ে বেশি। আর বাঙালি কনেকে শাড়িতে যতটা মিষ্টি লাগে, অন্য কিছুতে তা পাওয়া কঠিন। কেমন হবে বিয়ের শাড়ি, জানাচ্ছেন ফারহানা আলম
বিয়ের অনুষ্ঠানে বউ তো লাল শাড়িই পরবে, আবহমানকাল থেকে এমনটাই ভেবে আসছে বাঙালি। কিন্তু গত প্রায় দু–তিন দশকে এই ভাবনায় একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। একটু একটু করে শাড়ির জায়গা দখল করে নিয়েছে লেহেঙ্গা, ঠিক যেমনটা গায়েহলুদে আজকাল বাটিতে কাঁচা হলুদের পরিবর্তে রাখা হয় উপটান। আর এই পরিবর্তনের পেছনে পোশাকে আরামের ব্যাপারটি যেমন আছে, তেমনি আকাশ সংস্কৃতির প্রভাবও বেশ প্রকট।
তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, বিয়ের কনে অন্য যে পোশাকই বেছে নিন না কেন, শাড়ির আবেদন এখনো প্রথম। সম্প্রতি বিভিন্ন তারকাকেও দেখছি বিয়ের পোশাক হিসেবে শাড়িই বেছে নিচ্ছেন, তবে সেখানে থাকছে ব্যাপক পরীক্ষা–নিরীক্ষা।
কেউ হয়তো মায়ের বিয়ের বেনারসিটাই নিজের বিয়েতে নতুনভাবে পরছেন, আবার কেউ সেই শাড়ি নতুনভাবে তৈরি করে নিচ্ছেন সুবিধাজনক উপকরণে। বউ মানেই লাল শাড়ি, এ ধারণা ভেঙে এখন সাদা, কোড়া, সবুজ, বেগুনি—এ রকম রংও বেছে নিচ্ছেন বিয়ের কনে।
একটা সময় যেমন শুধুই বেনারসি বা জর্জেটে সিকোয়েন্স বা জারদৌসি কাজের শাড়িই কনের শাড়ি হিসেবে ব্যবহার হয়েছে, সেখানে এখন দেখা যাচ্ছে জামদানি, মসলিন, অরগঞ্জা, তসর, জরি ও কোটা।
শুধু শাড়িতেই জমকালো ভাব থাকলে চলবে না, শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজও হতে হবে বৈচিত্র্যপূর্ণ। তাই কাজ করা ডিজাইনের ব্লাউজ এখন কনের শাড়ির অনুষঙ্গে অন্যতম ট্রেন্ড।
শাড়ি যা–ই হোক না কেন, সাত-আট ঘণ্টা পরে থাকতে হয় বলে আরামটাই এখন মুখ্য। বিয়ের কনের শাড়ি মানেই ভারী এবং জবরজং হতে হবে—এ ধারণা থেকে বাইরে এসে এখন শাড়ি বাছাই করেন কনেরা। তাঁদের মাথায় থাকে বিয়ের পোশাকটা যেমন ট্র্যাডিশনাল হবে, তেমনি আরামটাও হওয়া চাই। আর একালের কনেদের কাছে সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে নিজস্ব স্টাইল। যেটা বিয়েবাড়িতে অবশ্যই অন্য সবার চেয়ে আলাদা হবে।
কনের শাড়ি বলে কথা, অন্য রকম তো হতেই হবে। তাই এখনকার ট্রেন্ড অনুসারে, শুধু শাড়িতেই জমকালো ভাব থাকলে চলবে না, শাড়ির সঙ্গে ব্লাউজও হতে হবে বৈচিত্র্যপূর্ণ। তাই কাজ করা ডিজাইনের ব্লাউজ এখন কনের শাড়ির অনুষঙ্গে অন্যতম ট্রেন্ড।
শাড়িটা যেহেতু শুধু একবার নয়, আরও কয়েকবার বিশেষ আয়োজনে ব্যবহার করা যায়, তাই অনেকে বাজেট মিললে জামদানি বেছে নিতে চান। তাঁতবস্ত্রে আমাদের ঐতিহ্য জামদানি সৌন্দর্য ও মর্যাদায় এখনো অদ্বিতীয়। সর্বোপরি, লাল জামদানিতে মোড়া কনের চেয়ে সুন্দর আর কী আছে! এর মধ্যে রয়েছে আমাদের নিজস্বতা।
সুতির জামদানি টেকসই হলেও জমকালো ভাবটা আবার হাফ সিল্কের জামদানিতেই বেশি ফুটে ওঠে। পিওর সুতির জামদানি আবার অনেক বাজেটেরও ব্যাপার। সেই তুলনায় কিছুটা কম দামে কেনা যায় হাফ সিল্কের মিশ্রণে তৈরি জামদানি। বিয়ের শাড়ি মানেই তো জরির কাজ। কিন্তু সেই পুরোনো হলদে জরি নয়; বরং কপার, ম্যাট গোল্ডেন বা হালকা সোনালি জরিটাই বিয়ের জামদানিতে এখন মানানসই। লালের পাশাপাশি মেরুন, অফ হোয়াইট, সাদা, রানি, নীল বা হালকা গোলাপি বা কমলা রঙের জামদানি শাড়িও বেছে নেওয়া যেতে পারে বিয়ের কনের জন্য।
বড় বড় ফ্যাশন হাউস ছাড়াও বর্তমানে ফেসবুক বা অনলাইনে অনেক শাড়ি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের কাছে নানা ধরনের জামদানি শাড়ির কালেকশনই আছে। নকশা ও সুতার কাউন্টের তারতম্যে দামেরও ভিন্নতা দেখা যায়। তবে জামদানি শাড়ি কেনার সময় সবচেয়ে জরুরি হলো শাড়িটা কতটা ঘন বুনন, সেটা দেখে নেওয়া। বুনন যদি বেশি ফাঁকা ফাঁকা হয়, তাহলে শাড়িটি পরে আরাম পাওয়া যাবে না, আবার খুব বেশি দিন সংরক্ষণও করা যাবে না।
বিয়ের জন৵ বিশেষভাবে জামদানি তৈরি করে নিতে চাইলে ডিজাইনারদের সঙ্গে কথা বলে সেভাবে বানিয়েও নেওয়া যায়। তখন কেবল শাড়ি নয়, সঙ্গে ব্লাউজটা কেমন হবে, ওড়নাটা জামদানি নাকি মসলিনের হবে—সেটাও ডিজাইনার ঠিক করে দেবেন। মনে রাখতে হবে, জামদানি বুননবৈচিত্র্যে এতটাই আভিজাত যে সেটায় অন্যভাবে ভ্যালু অ্যাডিশনের প্রয়োজন নেই।
আর যদি কাতান বা বেনারসিতে যেতে হয়, তাহলে শাড়িজুড়ে জরির কাজ নয়; বরং চিকন পাড় আর আঁচলে একটু ডিজাইন, সেখানেও জরির রঙের ব্যাপারটা মুখ্য। কাতান বাংলাদেশে একটি ক্ল্যাসিক ফেব্রিকস। জমকালোভাবে উপস্থাপনের জন্য কাতানে যত রং ও প্যাটার্নের নকশা সম্ভব, অন্য কোনো ফেব্রিকসে তা কল্পনাও করা যায় না। কাতান শাড়িতে মোগল ঐতিহ্যের পাশাপাশি বাঙালি সংস্কৃতিও মূর্ত হয়ে ওঠে।
মিরপুরের বেনারসিপল্লিতে অসংখ্য শাড়ির মধ্যে থেকে বেছে মনমতো বিয়ের শাড়িটি যেমন কিনতে পারবেন, তেমনি আবার একটু সময় হাতে রেখে মনমতো রং আর নকশায় তৈরি করে নেওয়াও সম্ভব।
মেশিন বা হ্যান্ড এমব্রয়ডারি, হ্যান্ড পেইন্ট, অ্যাপ্লিক—যেকোনোভাবেই মসলিন হয়ে উঠতে পারে অসাধারণ। বিভিন্ন মাধ্যমের সমন্বয়ে একটি কাপড়ে যে এত বৈচিত্র্য আনা সম্ভব, মসলিন না দেখলে তা বিশ্বাস করাটা কঠিন হতো।
ঢাকা শহরের নামি বুটিকগুলোতে এই সময়ে মসলিন শাড়ির বিশাল সংগ্রহ থাকে। এবারও সেই সংগ্রহে যোগ হয়েছে নতুন নতুন নকশা। মসলিনের সবচেয়ে ভালো দিক হলো এটি সম্পূর্ণ কাস্টমাইজযোগ্য। বেশির ভাগ ডিজাইনার কনের ইচ্ছা অনুযায়ী ওড়নাসহ কাস্টমাইজড মসলিন শাড়ি তৈরি করে দিতে পারবেন।
কনের শাড়ির জন্য রাজশাহী সিল্কটাও বেছে নেওয়া যেতে পারে। রাজশাহী সিল্কে হাতের কাজ বা জরি চুমকির এমব্রয়ডারি কনের শাড়িকে দিতে পারে ভিন্নমাত্রা।
আবার রাজশাহীর বলাকা সিল্ক, কাতান, মসলিনের মিশেলেও তৈরি হতে পারে দারুণ নকশার বিয়ের শাড়ি। তবে এসব পরীক্ষা–নিরীক্ষার জন্য হাতে যথেষ্ট সময় থাকতে হবে। একটা সময় শাড়ি, গয়না বা অন্যান্য অনুষঙ্গে মিল না রেখেই কিনে ফেলা হতো, এখন কিন্তু সেটা চলে না। বিয়ের শাড়ি মানেই একটু পরিকল্পনা করে সবটা বাছাই করতে হবে।
দেশীয় কাপড়ের পাশাপাশি জরি কোটা, নেট বা জর্জেটও বেছে নেওয়া যায়। এই শাড়িগুলোতে কনের জমকালো ভাবটা যেমন থাকে, তেমনি পরতেও অনেকে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। তবে অনুষঙ্গগুলো হওয়া চাই মানানসই। সব সময় মনে রাখতে হবে, শাড়িটিই মূল আকর্ষণ। তবে শাড়িটা যেন অন্য সব অনুষঙ্গকে ছাপিয়ে না যায়; বরং একটার সঙ্গে অপরটার সামঞ্জস্য থাকা জরুরি।
শাড়ির কাপড় ও কাজের সঙ্গে মানানসই গয়নাও চাই। একেবারে সাধারণ বিয়ের ওড়না যেমন চলবে না, তেমনি ব্লাউজের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রজোয্য। খুব জমকালো হতে হবে এমন নয়, তবে স্টাইলটা ফুটে উঠতে হবে। আর সব মিলিয়ে সেটা হতে হবে কনের ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই। কোনো কিছুই অতিরিক্ত নয়, সাধারণেই অসাধারণ কনের সাজের চলতিধারা।