মিছিলের ছবি তুলেই তারকার ছবি তুলতে গেলেন ফটোগ্রাফার
কেমন করে করা হতো শুরুর দিকের নকশাগুলো। ২৫ বছরের দীর্ঘ যাত্রায় আছে অনেক ছোট ছোট গল্প। সেগুলোই তুলে ধরা হলো এই প্রতিবেদনে।
দৈনিক পত্রিকার আলোকচিত্রীরা নাকি সকালে খান ইটপাটকেল, দুপুরে কাঁদানে গ্যাসের শেল। সে রকমই আলোকচিত্রীদের নিয়ে ২৫ বছর আগে ‘নকশা’র ফটোশুটের যাত্রা শুরু। রাজনৈতিক জনসভা শেষ করে দৌড়ে এসে করেছেন তারকার ফটোশুট। কোথায় পাব স্টুডিও? বার্তা সম্পাদকের ডেস্ক থেকে মিটিং রুম, একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে সেখানেই ছবি তোলা। শুরুর দিকে ‘নকশা’র ফটোশুট আয়োজনের দায়িত্বে ছিলেন অভিনেত্রী তাজিন আহমেদ (প্রয়াত), পরে অনেকেই পালন করেছেন এই দায়িত্ব। আজ ২৫ বছর পর পেছনে তাকিয়ে দেখি দেশসেরা ডিজাইনার, রূপবিশেষজ্ঞ, মডেল ফটোগ্রাফার, ফুড ফটোগ্রাফার, কোরিওগ্রাফারদের সমন্বয়ে যে ছবি তোলার আয়োজন করা হয়েছে, পাঠক তা গ্রহণ করেছেন আস্থায়, ভালোবাসায়।
প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে ছিল নবীন-প্রবীণের সম্মিলন। একদিকে শম্পা রেজার মতো অভিজ্ঞ অভিনেত্রী অন্যদিকে সে সময়ের জনপ্রিয় র্যাম্প মডেল পনির। আজ এ কথাও বলতে হবে, প্রথম সংখ্যা থেকে এখন পর্যন্ত দেশের জনপ্রিয় তারকারাই এসেছেন ‘নকশা’র প্রচ্ছদে। আবার কারও কারও যাত্রা শুরুই হয়েছে ‘নকশা’র হাত ধরে। ‘নকশা’র প্রচ্ছদে এসে চলচ্চিত্রের নাম ভূমিকায় অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছেন কেউ। হয়েছেন দেশের জনপ্রিয় তারকা।
তবে ‘নকশা’র প্রতি টান কমেনি এতটুকু। আজও ব্যস্ত শিডিউলের ফাঁকে ঠিকই ‘নকশা’র ফটোশুটের জন্য সময় বের করে নেন তাঁরা। তাঁদের সবার প্রতিই আমাদের কৃতজ্ঞতা।
‘নকশা’ শুরু থেকে রেসিপি প্রকাশে বিশ্বাসযোগ্যতার পরিচয় দিয়েছে। টাটকা রান্নার তাজা ছবি। দেশে তখন এত রান্নাবিদ, রান্নার স্কুল, অনলাইন পাতার চল হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানতাম, কার রান্নার হাত পাকা।
তাঁর সঙ্গে মিলে মৌসুমভিত্তিক, উৎসবধর্মী রান্নার আয়োজন করে নিজেদের যার যা আছে, তা দিয়েই পরিবেশনের চেষ্টা। প্রথম সংখ্যায় রান্না করেছিলেন রাজেশ্বরী প্রিয়রঞ্জনী (ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণীর বড় মেয়ে। হায়! মা-মেয়ে কেউই আজ আর নেই)। আজ ফরমাশ করলেই থিমভিত্তিক কেক পাওয়া যায়। তখন এর চল ছিল না। ইফফাত আরা (বর্তমানে সিঙ্গাপুরপ্রবাসী) নিজের সৃজনশীলতা খাটিয়ে তৈরি করতেন বিচিত্র কেক। ‘নকশা’য় ছাপা হতো তাঁর রেসিপি।
ঋতুভিত্তিক সাজ এখন ডাল-ভাত। শিল্পী ডিজাইনার (প্রয়াত) শাহরুখ শহীদকে সঙ্গে নিয়ে ‘নকশা’ প্রথম বসন্তের পোশাকের ফটোশুট করেছিল, অনেকটা নিরীক্ষাধর্মী কাজের মতো। অতঃপর বৈশাখে লাল, বর্ষায় নীল…। চিত্রশিল্পীদের আঁকা ষড়ঋতু থেকে রং নিয়ে ডিজাইনারদের সঙ্গে এক টিম হয়ে কাজ করা।
‘নকশা’ বরাবর দেশীয় পোশাক, উপকরণ নিয়ে ফিচার, ছবি প্রকাশ করেছে। এমনকি ‘বিয়ের বাজার দেশেই করুন’—এই স্লোগান সামনে নিয়ে ‘বিয়ে উৎসব’ করেছে বার কয়েক। বিয়ের মৌসুমে বিশেষ ‘নকশা’য় মডেল হয়েছেন তারকারা। পরেছেন জামদানি থেকে বেনারসি; সেজেছেন কানিজ আলমাস খান, ফারজানা শাকিলের মতো রূপবিশেষজ্ঞের সিগনেচার সাজে।
ঈদের সময় ফ্যাশন হাউসগুলো থেকে নির্বাচিত পোশাক নিয়ে আমরা নিজেদের আয়োজনে ছবি তুলে বিশেষ আয়োজন করতাম। ক্রেতারা সেই ‘নকশা’ হাতে করে দোকানে যেতেন। একবার দেশি পোশাকের একটি দোকানের একটি সালোয়ার-কামিজের ছবি ছাপা হয়েছিল, ওই দোকান ক্রেতার চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে হিমশিম খেয়েছিল। পরে তারা বলেছিল, আপনাদের নির্বাচিত পোশাকটি আমাদের আগেভাগে জানাবেন, মজুত বাড়িয়ে রাখতে হবে।
আরেকবার ঈদে একটি পোশাক কিনে পাঠক বিরক্ত হয়ে ফোন করে বলেছেন, ‘নকশায় ছবি দেখে জামা কিনলাম, এক ধোয়াতেই রং উঠে গেল। আমরা কিন্তু আপনাদের বিশ্বাস করি।’ আমরা সেই ডিজাইনারকে তৎক্ষণাৎ অভিযোগ জানিয়ে পাঠকের সঙ্গে যোগ স্থাপন করেছিলাম।
রান্না শুধু নারীরাই করেন, তা কিন্তু ‘নকশা’ মনে করে না। পাঁচতারা হোটেলের শেফ তো বটেই, শিল্পী মনিরুল ইসলাম, অভিনেতা এ টি এম শামসুজ্জামান, রাজ্জাক, আসাদুজ্জামান নূর, হুমায়ুন ফরিদী থেকে শুরু করে অভিনেতা আরেফিন শুভও রেঁধেছেন ‘নকশা’র পাঠকদের জন্য।
পাঠকদের ভালোবাসা, বিজ্ঞাপনদাতাদের আস্থা, জীবনযাপনের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভরসা—সবটা মিলিয়েই ২৫ বছর ধরে সময়ের সঙ্গে পথ চলছে ‘নকশা’। চলতে চায় আরও অনেকটা সময়। পাঠক, আপনি আছেন তো সঙ্গে?