সব আলোচনা পেছনে ফেলে এ মুহূর্তে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গরম কেবল একটি ইস্যু নিয়ে। আন্তর্জাতিক সেই ইস্যুটি হলো ভোগ ম্যাগাজিনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ও ওলেনা জেলানোস্কার কভার ফটোশুট। এই ছবি ও সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর যেন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে বিশ্ব। এক পক্ষ বলছে, ‘তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পূর্বমুহূর্ত এখন ফ্যাশন ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদ?’ আরেক পক্ষ ওলেনা জেলোনোস্কার সুরে সুর মিলিয়ে বলছে, ‘এই ফটোশুট আর সাক্ষাৎকার প্রকৃত অর্থেই ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে নারীদের শক্তি আর সাহসে উজ্জীবিত করবে।’ নেতিবাচকতা আগে স্থান পাওয়ার হেতু হলো, ভোগের এই ফটোশুট নিয়ে ইতিবাচক মন্তব্য যদি পাওয়া যায় একটি, তার বিপরীতে নেতিবাচক মন্তব্য কমপক্ষে পাঁচ গুণ।
এই ছবি তোলার জন্য ভোগের একটি দল ঝুঁকি নিয়ে গিয়েছিল ইউক্রেনের কিয়েভে, প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবনে। ভোগের এই ফটোশুটে ভলোদিমির ও ওলেনা দুজনই যেন দীর্ঘসময় আটকে রাখা মনের সব দুয়ার খুলে কথা বলেছেন। কথা বলেছেন নিজেদের প্রথম দেখা, প্রেম, দীর্ঘ বিবাহিত জীবন আর যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ও ফার্স্ট লেডি হিসেবে তাঁদের ভূমিকা নিয়ে।
ফটোশুটের ছবি শেয়ার করে ওলেনা তাঁর অফিশিয়াল ইনস্টাগ্রাম পেজে ৩০ লাখ ভক্তকে উদ্দেশ করে লেখেন, ‘ভোগের প্রচ্ছদে স্থান পাওয়ায় আমি চূড়ান্ত সম্মানিত। বিশ্বের সবচেয়ে সফল আর প্রভাবশালী নারীদের দেখা যায় এখানে। আমি ইউক্রেনের প্রত্যেক যোদ্ধা নারীকে এখানে দেখতে চাই। ঠিক আমার জায়গায়। যাঁরা যুদ্ধ করছেন, স্বেচ্ছাসেবা দিচ্ছেন, রিফিউজি ক্যাম্পেও জীবন চালিয়ে নিচ্ছেন, সাইরেনের শব্দে বিচলিত না হয়ে নিজের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এই নারীদের প্রত্যেকে এই প্রচ্ছদে স্থান পাওয়ার যোগ্য। আমি ইউক্রেনের প্রত্যেক নারীকে উদ্দেশ করে বলতে চাই, ভোগের প্রচ্ছদে (কেবল আমাকে দেখা গেলেও) আমি একা নই, আপনি, আপনারা সবাই আছেন।’ এরপর ওলেনা সম্পূর্ণ সাক্ষাৎকারটি পড়ার জন্য লিঙ্কও জুড়ে দেন।
ভোগের ফটোশুটের একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, গাঢ় নীল ওভারকোটে আচ্ছাদিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ওলেনা। তাঁর ডান হাত দৃঢ় বিশ্বাসে বুকে ধরে রাখা। খোলা চুলগুলো উড়ছে বাতাসে। পেছনে একটি ভাঙা যুদ্ধবিমান। দুই পাশে তিন নারী যোদ্ধা। এই ছবিটি প্রকাশ করে ভোগ ম্যাগাজিন তার ৩ কোটি ৯৮ লাখ অনুসারীর কাছে তুলে ধরেছে সাক্ষাৎকারের একটি বিশেষ অংশ। সেখানে ওলেনা বলেছেন, ‘এই সাক্ষাৎকারের ভেতর দিয়ে বিশ্ববাসীর কাছে আমি অস্ত্র চাই। যে অস্ত্র দিয়ে অন্য দেশের সীমানায় ঢুকে পড়ে মানুষের জীবন, ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয় না। বরং নিজেরা জেগে ওঠার জন্য আমরা অস্ত্র চাই। নিজেদের ঘরবাড়ি, সন্তান আর অস্তিত্ব রক্ষার জন্য আমরা অস্ত্র চাই।’
একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে, ওলেনাকে জড়িয়ে ধরে আছেন ভলোদিমির। পরনে টি–শার্ট আর প্যান্ট। এদিকে ওলেনার পরনে গাঢ় নীল রঙের হাতাওয়ালা হাই নেক টপ ও প্যান্ট। প্রায় দুই দশকের বিবাহিত সম্পর্কের নানা দিক ছাড়াও উঠে এসেছে যুদ্ধকালীন পরিবর্তিত পরিস্থিতির কথাও। ৪৪ বছর বয়সী ওলেনা বলেন, ‘যুদ্ধ শুরু হলো। সে (ভলোদিমির) সিদ্ধান্ত নিল কিছুতেই দেশ ছাড়বে না। আমি চিন্তিত ছিলাম। কিন্তু আমি তার সিদ্ধান্তকে সম্মান করি। আমি জানতাম, দ্রুত সবকিছু বদলে যাবে। আর সেই জটিল পরিবর্তন দীর্ঘসময় ধরে চলবে। আমি বুঝলাম, আমাদের শক্ত আর সাহসী হতে হবে। আমি আমাদের বিবাহিত সম্পর্কের সবচেয়ে জটিল সময়ে পা রাখলাম।’ এই সময় ভলোদিমির যোগ করেন, ‘ওলেনা আমার সারা জীবনের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। সে একজন দেশপ্রেমিক। সে ইউক্রেনকে সত্যিই খুব ভালোবাসে। আর সে একজন দুর্দান্ত মা।’
ভোগের প্রচ্ছদে অত্যন্ত স্মার্ট স্টাইলিংয়ে স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে নিজেকে উপস্থাপন করলেন ওলেনা। এ ক্ষেত্রে ইউক্রেনের ডিজাইনার বেটার, সিক্স, হভোয়া, দ্য কোট, কাচরভস্কা, পোস্তভিতের পোশাক বেছে নিয়েছেন তিনি। ছবিগুলো তুলেছেন অ্যানি লেইবোভিটজ। লিখেছেন র্যাচেল ডোনাডিও। আর স্টাইলিংয়ে ছিলেন জুলি পেলিপাস।
গতকাল এই ছবি আর সাক্ষাৎকার প্রকাশের পরই শুরু হয়েছে আরেক যুদ্ধ। তুমুল সেই যুদ্ধ চলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। টুইটারের হ্যাশট্যাগে একের পর এক ভেসে উঠছে—‘ওয়্যার অ্যান্ড পোজ’, ‘পাবলিসিটি স্ট্যান্ট’, ‘পাওয়ার কাপল’, ‘ব্রেভ ওম্যান’, ‘রোমান্টিসাইজিং দ্য ওয়ার’, ‘ওয়েস্টিং মানি কনট্রিবিউটিং টু ইউক্রেন’—এ রকম মিশ্র প্রতিক্রিয়ামূলক শব্দ। একজন কটাক্ষ করে লিখেছেন, ‘ভালোই যুদ্ধ থেকে একটা বিরতি নিলেন। সেজেগুজে পোজ দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখালেন, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ডলারগুলো খরচ করা হচ্ছে।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘যুদ্ধবিদ্ধস্ত ইউক্রেনের নাগরিককে এর চেয়ে ভালোভাবে অসম্মান করা যেত না!’ ‘সবকিছুকে, এমনকি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকেও পুঁজিবাদী ফ্যাশন বানিয়ে ফেললেন!’
অনেকে আবার এই ফটোশুটের পেছনে যৌক্তিক কারণ খুঁজে পাচ্ছেন। একজন লিখেছেন, ‘এই ছবি, এই সাক্ষাৎকার—এগুলো মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। এই ছবিগুলো বলছে, ইউক্রেনের মনোবল ভাঙেনি। তারা আছে, দিব্যি টিকে আছে আর থাকবে। অন্য পক্ষকে এভাবেই শক্তিশালী বার্তা দেওয়া হলো। সবাই সমালোচনা করছে। কিন্তু আমি এই প্রচ্ছদের সমর্থন করি। ভোগ ম্যাগাজিন বহুকাল পর সাহসের পরিচয় দিয়ে সত্যিকারের একটা কাজ করল।’
মার্কিন মানবাধিকারকর্মী স্কট প্রেসলার লিখেছেন, ‘আমরা ইউক্রেনকে ৫৪ বিলিয়ন ডলার দিলাম। যাতে করে প্রেসিডেন্ট আর তার স্ত্রী ভোগের ক্যামেরার সামনে সেজেগুজে পোজ দেয় আর তাদের প্রেমকাহিনি জানায়?’