পুলিশ ভ্যানের সামনে একা দাঁড়িয়ে নুসরাত বলেছিলেন, ‘আমার ওপর দিয়ে চালান’
পুলিশ ভ্যানের পথ রোধ করে দাঁড়িয়ে আছেন একা এক তরুণী। চোখে চশমা, কাঁধে ব্যাগ। ছবিটা অনেকের হৃদয়েই নাড়া দিয়েছিল। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেদিন যিনি এই প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন, তাঁর নাম নুসরাত জাহান। ঢাকার স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির এই শিক্ষার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম আমরা। জানতে চেয়েছিলাম, সেদিন ঠিক কী হয়েছিল?
দিনটা ছিল ৩১ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকা ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ কর্মসূচিতে অংশ নিতে বের হয়েছিল ঢাকার স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ছোট্ট একটা দল। এই দলে ছিলেন আইন বিভাগের নূর আলম হাসান ও অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের নুসরাত জাহান। পথে তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আরও দুই শিক্ষার্থী।
যেহেতু সংখ্যায় তাঁরা খুবই কম, তাই গ্রেপ্তার এড়াতে দুজন দুজন ভাগ হয়ে দূরত্ব রেখে এগোচ্ছিলেন। একপর্যায়ে হাইকোর্টের মাজার গেট থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান নেন তাঁরা। সেখানে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শতাধিক শিক্ষার্থী আগে থেকেই ছিলেন। কিছুক্ষণ পর পুলিশের একটি দল শিক্ষার্থীদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ছেলেদের আটক করতে শুরু করে। নুসরাত বলেন, ‘ওই সময় নূর ভাই আমার পাশেই ছিল। পুলিশ যখন নূর ভাইয়াকে নিয়ে যাচ্ছিল, আমি হাত ধরে রাখি। এ রকম অন্যায়ভাবে কাউকে তারা আটক করতে পারে না, তাই বাধা দিচ্ছিলাম। পরে একজন পুলিশ আমার হাতে আঘাত করে, ভাইয়াকে নিয়ে যায়।’
নুসরাত হাল ছাড়েননি। পেছন থেকে ছুটে এসে ভাইকে জাপটে ধরেন। তিনজন নারী পুলিশ তখন তাঁকে ছাড়িয়ে নেন। কোনো উপায়ান্তর না পেয়ে নুসরাত এবার গাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়ান।
একা।
ভয় করেনি? নুসরাত বলেন, ‘ওই সময় আমার মাথায় একটা জিনিসই ঘুরছিল—যেকোনো কিছুর বিনিময়ে হোক, ভাইয়াকে নিয়ে যেতে দেব না। যেহেতু আমাকে সাহায্য করার মতো কেউ সেখানে ছিল না, তাই গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে পড়া ছাড়া অন্য কোনো পথও ছিল না। এরপর পুলিশ আমাকে গাড়ির সামনে থেকে সরানোর চেষ্টা করে। ব্যর্থ হলে মহিলা পুলিশ ডাকে। তিনজন এসে আমাকে টেনে নিয়ে যায়। টানাহেঁচড়ার সময় আমার হাত সামান্য কেটে যায়।’
এক মায়ের পেটে না জন্মেও নুসরাত–নূরের সম্পর্ক আপন ভাই-বোনের মতো। বোনের সাহসী হয়ে ওঠার বাকি গল্পটা শোনালেন ভাই নূর আলম, ‘এই ঘটনার কয়েক দিন আগে নুসরাতের এক বন্ধুকে আন্দোলনস্থল থেকে পুলিশ আটক করে। সেদিন নুসরাত প্রতিজ্ঞা করেছিল, তার সামনে থেকে কাউকে আটক হতে দেবে না। আসলে ছাত্র থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের ওপর চলা অত্যাচার ওকে এত নাড়া দিয়েছিল যে মন থেকে ভয়ডর চলে গিয়েছিল। এমনকি পুলিশ ভ্যানের সামনে দাঁড়িয়েও ও বলছিল, “আমার ওপর দিয়ে চালান।” এখন হয়তো কথাটা খুব সহজ মনে হবে। কিন্তু তখনকার সময়ে এই প্রতিরোধের মানে অনেক বড়।’
সেদিন নূরকে আটক করে প্রথমে রমনা থানায় নেওয়া হয়। হাজতে রাখা হয়। আন্দাজ দুই ঘণ্টা পর তাঁর শিক্ষক, অগ্রজ-অনুজ, বন্ধু ও আত্মীয়রা থানায় আসেন। পরে তাঁকে শাহবাগ থানায় পাঠানো হয়। সেখান থেকে মুক্তি পান।
ওই ঘটনার পর অনেক মানুষের ভালোবাসা ও সম্মান পেয়েছেন বলে জানালেন নুসরাত। বলছিলেন, ‘কেউ কেউ আমাকে বলেছেন “২৪-এর প্রীতিলতা”। আবার অনেকে বলেছেন, ওই ৩১ জুলাইয়ের পরই তাঁরা নতুন করে সাহস পেয়েছেন। এমন অনেক শিক্ষার্থীও পথে নেমেছেন, যাঁরা আগে আন্দোলনে যোগ দেননি।’