খ্রিষ্টীয় নতুন বছরকে বরণ করে নেওয়ার বৈশ্বিক আয়োজন এখন বঙ্গদেশেও ‘প্রথা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্ষবরণের রাতে তাই এ দেশের আকাশেও আলোর ফুলকি ছোটে। হাওয়ায় ভাসে ফানুস। দৃষ্টিনন্দন সব আয়োজন। তবে সব আয়োজন কিন্তু ‘শ্রুতিমধুর’ নয়। ঘনবসতির এ দেশে সব উদ্যাপন ঠিক নিরাপদও নয়। আর বলতে খারাপ লাগলেও এ এক নির্মম সত্য, নতুন বছর উদ্যাপনের সময়কার সব আচরণ ঠিক সভ্যতা কিংবা ভব্যতার সীমার মধ্যেও থাকে না।
শব্দের যাতনা
আনন্দের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে আতশবাজি পোড়ানো বা পটকা ফোটানোর যে সংস্কৃতি, এর যাতনায় ভোগেন বয়োবৃদ্ধ ও অসুস্থ ব্যক্তি, ভয়ে কেঁদে ওঠে অল্পবয়সী শিশু। এসব শব্দের সঙ্গে যুক্ত হয় বিকট চিৎকার, উচ্চ শব্দের গান; ‘ফ্রি’ হিসেবে পাওয়া যায় ড্রামের ‘বিট’। এই ‘বিট’ গিলে খেতে চায় মানবদেহের হার্টবিট। খুব কাছ থেকে দেখেছি নিজের নানুকে। উচ্চ রক্তচাপের রোগী ছিলেন। এমন রোগীর কাছের মানুষেরাই হয়তো কেবল অনুভব করতে পারবেন নিদারুণ কষ্টের মাঝে এই রাতটা পার করার অভিজ্ঞতা।
এখানেই শেষ নয়
অনেকে আবার এ সময়টায় থাকেন পরীক্ষার দুশ্চিন্তায়। উৎসবপ্রিয় কেউ প্রতিবাদস্বরূপ বলতে পারেন, ‘জানুয়ারির শুরুতে আবার কিসের পরীক্ষা? স্কুল তো বন্ধ!’ তাঁরা ভুলে যান, স্কুল ছাড়াও থাকতে পারে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা, চিকিৎসকদের স্নাতকোত্তর পরীক্ষা। আপনার দূরতম প্রতিবেশী হয়তো এমন এক পরীক্ষার্থী, শব্দদূষণের যাতনায় যাঁর পড়ালেখা কিংবা বিশ্রাম, কোনোটাই হচ্ছে না।
নিজের অজান্তেই বছরের শুরুতে অন্যের কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ালেন আপনি। তা ছাড়া প্রাণিকুলের অনেক প্রজাতিই ধুমধাম শব্দে আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। এমনকি ঘরের মধ্যে থাকলেও নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছোটাছুটি শুরু করে এই ছোট প্রাণগুলো। তাই উচ্চ শব্দের সৃষ্টি হয়, এমন উপকরণকে বাদ দিয়ে নববর্ষ উদ্যাপনের আয়োজন করাটাই যুক্তিসংগত। গান বাজালেও সেই শব্দকে রাখুন সীমার মধ্যে।
কারও পৌষ মাস, কারও সর্বনাশ
শুভ ইচ্ছায় উড়িয়ে দেওয়া ফানুস কিন্তু দুর্ঘটনার কারণ হয়েও দাঁড়ায়। এমন করুণ সংবাদ আমরা ২০২২ সালের শুরুতেই পেয়েছি। এখন তো সত্যিই পৌষ মাস। শুষ্ক মৌসুম। অগ্নিদুর্ঘটনার মৌসুম। উড়ন্ত ফানুস কোথায় আটকে যাচ্ছে কিংবা জ্বলন্ত অবস্থায় কোথায় গিয়ে পড়ছে, আপনি হয়তো জানতেও পারছেন না। এভাবেই ‘সর্বনাশ’ ঘটে যেতে পারে কাছে-দূরে যত্রতত্র। অগ্নিদুর্ঘটনায় ক্ষতি হতে পারে মানুষের জীবনের; অতি কষ্টে জুগিয়ে রাখা ব্যবসায়িক কাঁচামাল পুড়ে যেতে পারে; পুড়ে যেতে পারে ছোট্ট পাখির বাসা, মারা পড়তে পারে পাখির মিষ্টি ছানারা। তাই সমুদ্রসৈকতের মতো বিরাট, উন্মুক্ত কোনো স্থানে যেতে না পারলে ফানুস নামের অনুষঙ্গটিকে বাদ দিয়েই উৎসব করুন। সচেতন মানুষ হিসেবে এটি আপনার দায়িত্ব। বরং মনের আকাশে উড়ুক কল্পনার ফানুস।
আচরণে সুশীল হোন
গেল বছর ৩১ ডিসেম্বর রাত ৯টা নাগাদ পথকুকুরকে খাবার দিয়ে ফেরার সময় দেখেছি, উঠতি বয়সী কিছু ছেলে পথচারীদের উপস্থিতির তোয়াক্কা না করেই পটকা ছুড়ে মারছে এদিকে-সেদিকে। অন্যের চলার পথে বাধা হয়, এ কেমন উদ্যাপন?
২০২২ তো চলেই গেল। নতুন একটা বছরের শুরুতে সামর্থ্যবানেরা কি একটিবার তাঁদের কথা ভাবতে পারেন না, যাঁরা দুমুঠো অন্নের জন্য যুদ্ধ করেন জীবনভর, জীর্ণ কুটিরে কিংবা খোলা আকাশের নিচে কাটান শীতের দুর্বিষহ রাত? বর্ষবরণের আয়োজন নিশ্চয়ই করবেন, তবে অপব্যয় কাম্য নয়। উদ্যাপনের অংশ হিসেবেও তো খেটে খাওয়া মানুষের জন্য কিছু একটা করতে পারেন। বন্ধুরা মিলে না হয় বছরের শুরুতে শীতবস্ত্র বিলিয়ে দিলেন কয়েকটি পরিবারের মধ্যে। এক বেলার বাজারের টাকা তুলে দিলেন কারও হাতে। আর নিজেদের খাবারের উচ্ছিষ্টটুকু দিয়ে এলেন পথপ্রাণীর আহারের জন্য, একটা পাত্রে ওদের একটু পানি দিলেন; পুরোনো, ছেঁড়া কাপড়ের টুকরাগুলো বিছিয়ে দিলেন বাড়ির মূল ফটকের পাশে, যেখানে নিরাপদে একটু ওম পেয়ে ঘুমাবে কোনো অসহায় প্রাণী, বৃষ্টি হলে ওদের একটু আশ্রয় দেওয়ার অনুরোধ করলেন বাড়ির নিরাপত্তাকর্মীকে। প্রশান্ত এক উদ্যাপনে বর্ষবরণটা কেমন জমে, দেখবেন নাকি একটিবার?