বন্ধু দিবস
বন্ধুত্ব নিয়ে চারটি গল্প, যা আপনাকে অনুপ্রেরণা দেবে
আজ বন্ধু দিবসে পড়ুন লিংকডইনের সহপ্রতিষ্ঠাতা রেইড হফম্যানের একটি বক্তৃতা। যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে ‘বন্ধুত্ব’ প্রসঙ্গে কথাগুলো বলেছেন তিনি।
আজ আমি বন্ধুত্ব নিয়ে কথা বলব। হলমার্কের উপহার, গোলাপ কিংবা খরগোশের পুতুল দেওয়া বন্ধুত্ব নয়। সত্যিকার, বাস্তবিক বন্ধুত্ব—যে বন্ধুত্ব কখনো কষ্ট দেয়, কখনো জীবন গড়ে দেয়, কিংবা বদলে দেয়। নিজের জীবনের চারটি গল্প দিয়ে আমি বন্ধুত্বের গুরুত্ব বোঝাতে চেষ্টা করব।
প্রথম গল্প
প্রথম ঘটনা থেকে আমার শিক্ষা: যখন গুরুত্বপূর্ণ কিছু তোমার অজানা থাকবে, সত্যিকার বন্ধুরা ঠিকই তোমাকে জানাবে।
কলেজের প্রথম দিকে পরিচয় হয় কিনডার্নের সঙ্গে, যে আমার সঙ্গে কথা বলতে পছন্দ করত বলে মনে হতো। বিশ্বসভ্যতা কোর্সে আমাদের আলাপ। ধীরে ধীরে একে অপরের পরিবার সম্পর্কে জানতে শুরু করি, ডেটিংয়ে ঘটা দুর্ঘটনা নিয়ে কথা বলি, দুজনের খুঁতগুলোও একে অপরের চোখে পড়তে থাকে। মোদ্দাকথা, আমরা বন্ধু হয়ে উঠি। একদিন হঠাৎ কিনডার্ন বলে বসে, ‘রেইড, মানবজাতির অর্ধেক সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই।’ অর্থাৎ নারীদের সম্পর্কে। অতটা চাঁচাছোলাভাবে সে বলেনি, কিন্তু এটাই বোঝাতে চেয়েছে।
সত্যিই। অনেক পুরুষের মতোই নারীদের সম্পর্কে আমার জ্ঞান ছিল শূন্যের কাছাকাছি। কিনডার্ন আমাকে কথা বলেই ক্ষান্ত হয়নি। সাহায্যও করতে চেয়েছে। তার বান্ধবীদের আড্ডায় আমাকে সে নিয়ে গেছে। যদি মেয়েদের আলাপ শুনতে আমি আগ্রহী হই। এখানে ‘যদি’র কোনো অবকাশই অবশ্য নেই। আগ্রহী হব না মানে!
তো এক বিকেলে ডর্মের বাইরে দাঁড়িয়ে আমি কিনডার্ন আর তার মেয়েবন্ধুদের আড্ডায় শামিল হলাম। ওরা এমন খোলা মনে কথা বলছিল, যেমনটা আমি আমার ছেলেবন্ধুদের সঙ্গেও কখনো বলি না। ওদের কথা শুনে কখনো কখনো আমার গাল লাল হয়ে উঠছিল।
তবে শুধু মেয়ে হওয়ার কারণে মেয়েদের যে প্রতিদিন এত রকম বাজে কথা শুনতে হয়, এ সম্পর্কে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। অবাক হয়ে বলছিলাম, এভাবে একেকটা দিন কী করে পার করো তোমরা!
কিনডার্ন সেদিন আমাকে না নিয়ে গেলে অনেক কিছুই আমার অজানা থেকে যেত। এর পর থেকে সম্পর্কের ব্যাপারে আমি আরও সতর্ক হই। এই অভিজ্ঞতা আমাকে আরও ভালো বন্ধু, ভালো বস, ভালো স্বামী, ভালো বিনিয়োগকারী হতে শিখিয়েছে।
দ্বিতীয় গল্প
দ্বিতীয় ঘটনা কলেজ পেরোনোর এক বছর পরের। আর এ ঘটনা থেকে শিক্ষা হলো: তুমি যা দেখতে পাচ্ছ না, বন্ধুরা তা দেখতে সাহায্য করে।
২২ বছর বয়সে জীবন নিয়ে আমার কী ভাবনা ছিল? আমি পৃথিবীকে সত্যিকার অর্থেই আরও সুন্দর করতে চেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, এর একটা ভালো উপায় হলো মূল্যবোধ ও নীতি নিয়ে কাজ করা, সমাজে আমাদের ভূমিকা কী হওয়া উচিত—এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। তাই দর্শন নিয়ে পড়ব বলে অক্সফোর্ডে ভর্তি হলাম। অক্সফোর্ডের দর্শনের শিক্ষকেরা বিশ্বসেরা। কিন্তু তাঁরা বেশির ভাগ সময় নিগূঢ় তত্ত্ব নিয়ে কথা বলতেন, যার মধ্যে ‘সত্যিকার মানুষ’ নেই বললেই চলে।
অতএব বুঝলাম, দর্শন আমার জন্য নয়। কিন্তু কী করব, বুঝতে পারছিলাম না। একরকম দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। সৌভাগ্যক্রমে স্টেফান নামে আমার এক বন্ধু ছিল। আমার কষ্ট সে বুঝতে পারছিল। একদিন আমাকে প্রশ্ন করল, ‘তুমি সমাজের জন্য বড় পরিসরে কিছু করতে চাও, তাই তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেন ভাবছ দর্শন তোমার একমাত্র পথ?’
তাই তো!
স্টেফান বলল, যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তোমাকে সাহায্য করতে না পারে, অন্য পথ ধরো।
সত্যিই তো, পরিবর্তন আনার আরও অনেক পথ আছে। অতএব কোনো সঞ্চয় ছাড়া, কোথায় যাচ্ছি সে সম্পর্কে কোনো ধারণা ছাড়া ঝুঁকিটা নিয়েই ফেললাম। ফিরে গেলাম সেখানে, যেখানে আমি বড় হয়েছি—নর্দার্ন ক্যালিফোর্নিয়া। বড় পরিসরে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার জন্য আমি প্রযুক্তিশিল্পে একটা এন্ট্রি লেভেলের কাজ খুঁজছিলাম।
স্পয়লার অ্যালার্ট! পরে এই চেষ্টা কাজে লেগেছে। বন্ধুরা না থাকলে যা কখনোই সম্ভব ছিল না।
তৃতীয় গল্প
পরের শিক্ষা: তুমি যা শুনতে চাও, বন্ধুরা তোমাকে তা বলবে না। বরং সেটাই বলবে, যা তোমার শোনা দরকার। ২০০২ সালের কথা। তখন আমি পেপ্যালের নির্বাহী দলের সদস্য। টানা কয়েক বছর সপ্তাহে ১০০ ঘণ্টা কাজ করেও, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়মের প্যাঁচে পড়ে আমরা তখন ই বে-র কাছে পেপ্যাল বিক্রি করে দিয়েছি।
বয়স ৩৫। তখন আমি একেবারেই ভেঙে পড়েছি। ঠিক করেছিলাম, সিলিকন ভ্যালি থেকে দূরে বেড়াতে যাব। এক বছরের ছুটি নেব। সবাই বলল, দারুণ সিদ্ধান্ত।
প্রথমেই গেলাম অস্ট্রেলিয়া। স্কুলের বন্ধু নেডের কাছে। আমাকে সময় দেওয়ার জন্য কয়েক দিনের ছুটি নিয়ে ফেলল নেড। দক্ষিণ সিডনিতে, সাগরপাড়ের এক বাংলোয় সময়টা ভালোই কাটছিল। কিন্তু একদিন নেড বলল, ‘তো? পেপ্যালের পর কী?’
বললাম, ‘ইদানীং ফ্রেন্ডস্টার নামে একটা ওয়েবসাইট দেখছি। ওরা মানুষের সামাজিক জীবন বদলে দিচ্ছে (ফেসবুক তখনো ছিল না)। তাই আমিও একটা ভিন্ন ধরনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম গড়ে তুলব বলে ভাবছি, যেটা মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করবে।’ সত্যিই আইডিয়াটা নিয়ে খুব রোমাঞ্চিত ছিলাম। তবে তার আগে এক বছরের ঘোরাঘুরি পরিকল্পনাটা আমার কাছে আরও রোমাঞ্চকর মনে হচ্ছিল।
কিন্তু নেডের কাছে মনে হচ্ছিল না। সে বলল, ‘আমি জানি, পেপ্যাল নিয়ে তুমি অনেক চেষ্টা করেছ। কিন্তু এরপর যেটা নিয়ে কাজ করবে বলে ভাবছ, সেটা আরও ভালো শোনাচ্ছে। আর তুমি তো জানো, প্রযুক্তিশিল্প কীভাবে কাজ করে। ছয় মাস পরে নয়, তোমার আইডিয়া নিয়ে এক্ষুনি কাজ শুরু করা উচিত। বেড়ানো বাদ দিয়ে ভ্যালিতে ফিরে যাও। যত দ্রুত সম্ভব।’
জানতাম, আমাকে চেনে বলেই এ কথা বলছে নেড। পরের অংশটা অনুমান করতে পারছেন নিশ্চয়। টিকিট বদলে দেশে ফিরে এলাম। যা নিয়ে কাজ শুরু করলাম, সেটাই পরে লিংকডইনে রূপ নিল। নেড ঠিকই বলেছিল, আমার তখনই শুরু করা উচিত ছিল।
ভালো কথা। আমার গল্পের বার্তা কিন্তু এটা নয় যে ‘কখনোই ছুটি নিয়ো না। সব সময় আরও বেশি কাজ করো।’ সেটা খুব বোকার মতো কথা হবে।
চতুর্থ গল্প
চতুর্থ শিক্ষাটা একটু অদ্ভুত মনে হতে পারে—বন্ধুরা তোমাকে সাহায্য করার সুযোগ দিয়ে আদতে তোমাকেই সাহায্য করছে।
এক মধ্যরাতে অস্কারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বহু বছরের বন্ধু আমরা। অস্কারকে আমরা বুদ্ধিমান, চিন্তাশীল, সম্মান পাওয়ার যোগ্য বলেই জানতাম। কিন্তু যে সময়টার কথা বলছি, সেই সময়ে ও খুবই অবিবেচকের মতো কাজ করছিল। ইচ্ছা করেই ছয় বছর ধরে নিজের স্ত্রীকে এমন এক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে চাইছিল, যেন স্ত্রী ওকে ডিভোর্স দেয়। সেই রাতে অস্কার স্বীকার করেছিল, আসলে ওর সরাসরি স্ত্রীর মুখোমুখি হওয়া উচিত। একসঙ্গে থাকতে চাই, নাকি চাই না, পরিষ্কার আলাপ করা উচিত। এরপর অনেক ঘটনা ঘটেছে। মোদ্দাকথা হলো, সেই রাতে আমাদের আলাপ অস্কারের জীবনে বড় পরিবর্তন এনেছিল। স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে অস্কার এখন ভালো আছে।
কিন্তু অস্কারের গল্প এখানে মুখ্য নয়। কেননা, অস্কার আজ এখানে উপস্থিত নেই (তা ছাড়া ওর নাম আদৌ অস্কার নয়। বন্ধুর ব্যক্তিগত জীবনের গল্প ফাঁস করে দিই কী করে!)।
গল্পটা বললাম কারণ এটা আমার জীবনেও একটা বড় অভিজ্ঞতা। অস্কার সেদিন আমার ওপর পূর্ণ আস্থা রেখেছিল। আমাকে বিশ্বাস করেছিল। যেটা আমার জন্য একটা বড় পাওয়া। কারণ, ও আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, আমার ওপর আস্থা রাখা যায়। আমি আস্থা পাওয়ার যোগ্য। সেই অনুভূতি আমি কখনো ভুলব না। (সংক্ষেপিত)
ইংরেজি থেকে অনুদিত
সূত্র: গ্রেলক ডটকম