রমজানে স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখবেন কীভাবে
রমজানে অনেকটা রাতারাতিই বদলে যায় জীবনধারা। অনেকেরই অফিস সময় বদলে যায়, বদলায় ছোটদের স্কুলের সময়ও। সাহ্রির জন্য শেষ রাতে উঠতে হয়, ফলে ঘুমের রুটিনও উল্টাপাল্টা হয়ে যায়। এই বদলের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অনেকের সময় লেগে যায়। দেহমনে আসে অবসন্নতা। সব দিক সামলে স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা আসলেই ঝক্কির কাজ। তবে সুস্থ থাকতে খাবারদাবার, ঘুম, শরীরচর্চা—সবই ঠিক রাখতে হবে। আর জীবনের প্রয়োজনগুলোর প্রতি একটু খেয়াল রেখে রোজকার জীবনবিধি নির্ধারণ করে নিলে রমজানেই গড়ে তোলা যায় প্রশান্তিময় জীবন।
রমজানে খাবারদাবার বাছাইয়ে হতে হবে সচেতন। বুফে রেস্তোরাঁয় যত খুশি তত ইফতার না খাওয়াই ভালো। ‘আনলিমিটেড অফার’ এড়িয়ে চলুন। বুঝেশুনে খান। সংযমী হোন, আর অবশ্যই পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিন। আগেই বলেছি, রমজানে ঘুমের রুটিন একটু এলোমেলো হয়ে যায়। এর মধ্যে নিজের কাজের ধরন এবং সময় বুঝে ঘুমের সময় বের করে নিতে হবে। অপ্রয়োজনীয় বাড়তি কাজে সময় অপচয় হলে ঘুমের সময় কিন্তু এমনিতেই কমে আসে। এই যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। খাবারের আগে-পরে কিংবা ঘুমানোর সময় যদি মুঠোফোনে সময় কাটিয়ে দেন, তাহলে ঘুমের সময় পাবেন না। মুঠোফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখতে মন তো চাইতেই পারে। কিন্তু ‘একটু’ সময়ের জন্য ভাবলেও এভাবে আপনি হয়তো মনের অজান্তেই বহু সময় কাটিয়ে ফেলেন। এতে চোখেও চাপ পড়ে, ক্লান্তি বাড়ে। অথচ আপনি হয়তো টেরও পান না জীবনের কতটা সময় এভাবে হারিয়ে যায়।
সুস্থতার জন্য অবশ্যই ঘুমাতে হবে ঠিকঠাক। রাজধানীর পপুলার ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মেডিসিন কনসালট্যান্ট ডা. সাইফ হোসেন খান বলেন, রমজানে হয়তো একটানা লম্বা সময় ঘুমানোর সুযোগ পাচ্ছেন না। কিন্তু রাতের মূল সময়টায় ঘুমের পাশাপাশি দিনেও কিছুটা সময় বিশ্রাম করা যেতে পারে। সকালে অফিসে যাওয়ার তাড়া থাকলে সাহ্রির পর ঘুমিয়ে আবার ওঠা কঠিন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সাহ্রির পর খানিক হাঁটাহাঁটি বা শরীরচর্চা করা যেতে পারে। এরপর গোসল করলে বেশ সতেজবোধ করবেন। যাঁদের অনেক বেলা অবধি ঘুমানোর অভ্যাস, তাঁরাও রমজানে এই নিয়ম অনুসরণ করতে পারেন।
খাবারদাবার যেমন হবে
ঢাকার গভর্নমেন্ট কলেজ অব অ্যাপ্লায়েড হিউম্যান সায়েন্সের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শম্পা শারমিন খান বলছিলেন, রমজান মাসে হালকা খাবার খাওয়াই ভালো। অতিরিক্ত তেল-মসলা এড়িয়ে চলতে হবে। ইফতার থেকে সাহ্রি পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সারা দিনের প্রয়োজনীয় খাবার এবং পানি ধাপে ধাপে খাওয়া উচিত। রোজকার খাদ্যতালিকায় প্রচুর ফলমূল ও সবজির সালাদ রাখুন। তাজা ফল কিংবা দুধ দিয়ে তৈরি নানারকম পানীয়ও খেতে পারেন। স্বাদে বৈচিত্র্য আসবে।
শিশুদের জন্য করণীয়
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের শিশু বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. তাসনুভা খান জানান, বড়দের চাইতে বাড়ন্ত বয়সে ঘুমের চাহিদা থাকে বেশি। শিশুর পর্যাপ্ত ঘুম নিশ্চিত করাও জরুরি। রমজান মাসে স্কুলের পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিশুকে সহযোগিতা করুন। কোন সময় ঘুমালে কোন সময় ওঠা তার জন্য সহজ হবে, সেই হিসাব রাখুন। এরপর সেভাবেই তাকে রোজ ঘুম পাড়িয়ে দিন। কোনো কোনো শিশু সিয়াম পালনও করে। ইফতারে প্রচলিত ভাজাপোড়া খাবার খাওয়ার রীতি যদি আপনার বাড়িতে চলে, সে ক্ষেত্রে আপনার শিশুও সেই খাবারই গ্রহণ করবে। তাই স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখার চেষ্টা করুন। শিশুর পর্যাপ্ত পানি গ্রহণ নিশ্চিত করুন। তাজা ফলমূল, শাকসবজি খেতে উৎসাহ দিন। রোজ ডিম ও দুধের মতো পুষ্টিকর খাবার দিতে চেষ্টা করুন। একেবারে অবুঝ শিশু অনেক সময় ইফতার বা সাহ্রির সময়টাতেও মাকে কাছে চায়। এমন হলে শিশুর অন্যান্য আপনজনেরও শিশুর প্রতি যত্নশীল হয়ে উঠতে হবে, যাতে মা নিজের জন্য কিছুটা সময় পান।
রোজার সময় শরীরচর্চা
পাঁচ তারকা প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের প্যাসিফিক ফিটনেসের সুপারভাইজার ও ট্রেইনার আনোয়ার করিম মনে করেন, রমজান মাসে ফজরের নামাজের পরের সময়টায় ব্যায়ামের জন্য আদর্শ সময়। এ সময় আধঘণ্টা কার্ডিও ও আধঘণ্টা হালকা ওয়েট ট্রেনিং করা যেতে পারে। কার্ডিও হতে পারে ট্রেডমিল বা সাইকেলে। কিংবা ক্রস ট্রেইনিংও করতে পারেন। সব শেষে স্টিম নিয়ে গোসল করে ফেললে বেশ সতেজ অনুভূতি হয়। বাসায় স্টিমের মতো সতেজ হতে চাইলে বাথরুমের দরজা ও ভেন্টিলেটর বন্ধ করে কিছুক্ষণ গরম পানির বাষ্পে বসে থাকুন। সারা দিন ব্যায়ামের জন্য আর ভাবনাও থাকে না। সজীবতা নিয়ে দিনের কাজ শুরু করা যায়। তবে রমজানে তারাবিহসহ সারা দিনের নামাজে বেশ ভালো শরীরচর্চা হয়। তাই খুব ভারী ব্যায়াম না করলেও ক্ষতি নেই। এক ঘণ্টার এই ব্যায়ামের অভ্যাস গড়ে তুললেই শরীরটা ‘ফিট’ থাকবে। তা ছাড়া রমজান মাসে প্রতি তিন দিন ব্যায়াম করার পর এক দিন বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন বলে জানান এই ফিটনেস ট্রেইনার। কেউ কেউ অবশ্য তারাবিহ্র নামাজের পরেও ব্যায়াম করতে চান। যদিও সেই সময়টায় শরীর অবসন্ন হয়ে পড়ে। তবে ব্যায়ামে অভ্যস্ত ব্যক্তির পক্ষে সেই সময়ও খারাপ নয়। এ সময় কারও পক্ষেই ভারী ব্যায়াম খুব একটা উপযোগী নয়; বরং খানিকটা হাঁটাহাঁটি করা যেতে পারে। তবে যে সময়ই ব্যায়াম করা হোক না কেন, ৪০ পেরোনো ব্যক্তির জন্য ব্যায়ামের অভ্যাস ধরে রাখাটা জরুরি।
যাঁরা রাতে কাজ করেন
অন্তর্জালের এ সময়ে গোটা পৃথিবী এক হয়ে গেছে। দেশে বসেই তাই অনেকে বিদেশের চাকরি করছেন। টাইম জোনের ভিন্নতার কারণে অনেকের হয়তো তাই অনলাইনে অফিস করতে হয় রাতে। আবার দেশেও নানা পেশার লোকের রাতের শিফটে কাজ করতে হয়। এমন হলে খাবার ব্যবস্থাপনা থেকে শুরু করে ঘুমের রুটিন সবকিছুই মিলিয়ে নিন রমজানের সঙ্গে। অফিস যদি সন্ধ্যার পরেই শুরু হয়, তাহলে কাজ শেষ করে সাহ্রি সেরে তারপর ঘুমাতে যেতে পারেন। তবে কমপক্ষে ছয়–সাত ঘণ্টা ঘুম নিশ্চিত করুন।