সন্তানকে ছোটবেলায় যেসব বই পড়ালে সে এগিয়ে থাকবে
শিশুকে কী ধরনের বই পড়তে দেবেন, এ নিয়ে চিন্তায় থাকেন যেসব অভিভাবক, তাঁদের জন্য এই লেখা। যদিও এটি লেখা হয়েছে শিশুদের উদ্দেশ্য করে
মানুষ ভাষা তৈরি করেছে অন্যের কাছে নিজের মনের ভাব প্রকাশ করতে গিয়ে। মনের ভাব কথা হয়ে প্রকাশ পায়। মনে কত যে ভাব তৈরি হয়, গুনে শেষ করা যায় না। খেয়াল করলে দেখবে নানা ঘটনা বা অভিজ্ঞতার সঙ্গে সঙ্গে তোমার মনের ভাবও পাল্টে যাচ্ছে—কখনো খুব রাগ হচ্ছে, তো কখনো মনটা খারাপ হয়ে একেবারে গলে যায়। একবার চেঁচিয়ে রাগ ঝাড়ছ, তো আরেকবার ধরা গলায় কান্নাভেজা কণ্ঠে প্রায় অস্ফুটস্বর, কথা না বলে পারছ না। মান-অভিমান, রাগ-ক্ষোভ, দুঃখ-বিষাদ, ভালোবাসা-অনুরাগ এবং আরও কত রকম ভাব তো আছেই, আবার ভাব নয় শ্রেফ কোনো খবর দিতে, কোনো খবর জানতেও তো কথা বলতে হয়। কথা নেই, এমন অবস্থা ভাবো একবার, দমবন্ধ হয়ে আসবে।
মানুষ যেমন বুদ্ধিমান, তেমনি সৃজনশীল এক প্রাণী। তার মেজাজ-মর্জির বৈচিত্র্য যেমন, তেমনি তা প্রকাশের ভাষাও বিচিত্র। যে-ই লিপি তৈরি করেছে, অমনি শুরু হলো সাহিত্যের সৃষ্টি। এখন ভাষা জানার অর্থ হলো লিখে ও শুনে বুঝতে তো পারতেই হবে, আবার অন্যের লেখা পড়েও বুঝতে হবে, নিজের লেখা এমনভাবে লিখতে হবে যেন পড়ে অন্যেও বোঝে। তাই ভাষা ভালো করে রপ্ত না করে উপায় নেই।
মাতৃভাষাই আগে শিখতে হবে। জন্মের পর থেকেই তো কথা শিখি, বলি ও শুনি। এভাবে কথাবার্তা বলা ও শোনা অর্থাৎ বলে বোঝানো আর শুনে বোঝার ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়। কিন্তু এখন বহুকাল হলো মানবসমাজ লেখার মাধ্যমে ভাব-বার্তা তথ্য-বিনিময় করেই চলেছে। তাই লেখা পড়া এবং পড়ে বোঝার দক্ষতা সবারই আয়ত্ত করতে হয়।
খেয়াল করেছ কখনো যে বড়রা অনেকেই খুব খেপে গেলে মাতৃভাষা ছেড়ে ইংরেজিতে ধমকের তুবড়ি ছোটান। ‘ইউ রাস্কেল’, ‘গেট আউট’ ইত্যাদি বলেন। রাগ করা ভালো নয়, তবে এখানে সমস্যা হলো ভদ্রলোক রাগ প্রকাশের উপযুক্ত শব্দ বাংলায় খুঁজে পাচ্ছেন না। একটু খেয়াল করলে দেখবে আজকাল ছেলেমেয়ে-বুড়ো প্রায় সবাই কথার মধ্যে ইংরেজি শব্দ গুঁজে দিচ্ছেন। এ রকম সব টুকরো কথা কানে আসে—রাগটা কন্ট্রোল করা উচিত ছিল, ব্রেকফাস্ট হয়নি, ফ্রেন্ডরা মিলে ট্যুরে যাচ্ছি, ইভনিংয়ে কী করছিস ইত্যাদি। যেকোনো ভাষাই নমনীয়, ব্যবহার বাড়লে প্রচুর বিদেশি শব্দ গ্রহণ করে। কিন্তু নির্বিচার বিদেশি (আমাদের ক্ষেত্রে কেবল ইংরেজি) শব্দ প্রয়োগ চলতে থাকলে, সেই শব্দের বাংলা প্রতিশব্দটি অব্যবহারে প্রথমত অপরিচিত ঠেকবে এবং পরে মনে হবে এ তো অপ্রচলিত শব্দ। একসময় সত্যিই সেই শব্দটি সাধারণের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে উঠবে।
মানুষ একাধিক ভাষা জানতে পারে। কিন্তু কখনোই মাতৃভাষায় দুর্বল থেকে অন্য ভাষার দক্ষতাকে উচ্চপর্যায়ে নেওয়া সম্ভব নয়। বরং মাতৃভাষার মানসম্পন্ন জ্ঞান অন্য ভাষা শেখায়ও সহায়ক হবে। কারণ, ভাষা তো কেবল কথা বলা, লেখাপড়ার বিষয় নয়, মানুষের জীবনও কেবল খেয়েদেয়ে চাকরি-সংসার চালিয়ে যাপনেই শেষ করার বিষয় নয়। মানুষ জীবনটা যাপনের সঙ্গে সঙ্গে উপভোগ করে, উদ্যাপন করে। সে তো কেবল সোজা কথা আর বেঁচে থাকার মধ্যে জীবনের মানে খুঁজে পায় না, আনন্দও না। তার ক্ষুধা বা চাহিদাও তাই নানা রকম। বন্ধু চাই, অবসর চাই, রসবোধের তৃপ্তি চাই, চাই রং-সুরের বাহার। তার কখনো দার্শনিকতার ভাব আসে, আধ্যাত্মিকতা তাকে ছাড়ে না, জীবনের নানা রস-রসদ জানতে ও পেতে তার গভীর আগ্রহ। এমন একটি সুন্দর সজীব বিকাশমান মনের ভিত্তি তৈরি করে সাহিত্য ও সাহিত্যপাঠ। এতে ভাষার ওপর দখলও তৈরি হয়। এখন কথা হলো ভালোভাবে শিখব কোন পথে? উত্তর একটাই, সেই ভাষার উত্কৃষ্ট সাহিত্য পাঠ করে। এ ক্ষেত্রে আমরা মাতৃভাষার সেরা সাহিত্যপাঠের কথাই ভাবব। এই লেখায় একটু জোর দেব গদ্যে, ভালো গদ্য রচনার ওপর। কারণ, সব রকম কাজের জন্যই চাই উপযুক্ত গদ্য রচনার দক্ষতা।
তাই আমি বলি কি, পড়া থাকলেও ছোটবেলার বই বলে সরিয়ে না রেখে বাংলা ভাষার জাদুকরি শক্তির স্বাদ নিতে পড়ো। আবার পড়ো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সহজপাঠ ২য় ভাগ, ছেলেবেলা, গল্পগুচ্ছ, ছিন্নপত্র। এগুলো পড়লে সহজ বাংলায়ও কত ভাব, কত ছবি, কত রং, কত সুর ফুটিয়ে তোলা যায়, তার সুন্দর সুন্দর নজির পাবে। আরেকবার দক্ষিণারঞ্জন মিত্র-মজুমদারের ঠাকু’মার ঝুলি পড়তে ভুলো না (সাধুভাষায় হলেও কী যে বাঙ্ময় প্রকাশ), তাকে উপেক্ষা করো না। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অন্তত ক্ষীরের পুতুল, নালক, শকুন্তলা পড়লে ভাষা কীভাবে কল্পনায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ তৈরি করে, তার দেখা পাবে। এই সঙ্গে চেনা চরিত্রের নানা ঘটনায় জমাটি গল্প পড়তেও ভুলো না। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা এবং সেই সঙ্গে শিবরাম চক্রবর্তীর গোবর্ধন-হর্ষবর্ধনদের নিয়ে গল্পগুলো পড়তে পার। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা ও শঙ্কু সিরিজেও ঝরঝরে গতিশীল বাংলা ভাষার দৃষ্টান্ত পাবে। মজার গল্প পাবে সাজেদুল করিমের চিংড়ি ফড়িঙের জন্মদিনে বইতে।
সুবিধার জন্য বরং ওপরে উল্লেখ করা বইগুলো বাদ দিয়ে আরও কিছু বইয়ের তালিকা করে দিই। মনে রাখবে, এটা আমারও লেখার সময়ে যা মনে পড়েছে সেই তালিকা। আমারও অসম্পূর্ণ, অন্য যাঁরা পড়েন-জানেন, তাঁদের জন্যও অসম্পূর্ণ। কিন্তু কোথাও থেকে তো শুরু করতে হবে, সেভাবেই এই অসম্পূর্ণ তালিকা থেকে নাহয় শুরু হোক।
উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর সব বইই ছোটবেলায় পড়ার উপযোগী—গুপী গাইন বাঘা বাইন, মজন্তালী সরকার তো পড়বেই, পড়তে ভুলো না তাঁর অনবদ্য টুনটুনির বই আর ছেলেদের রামায়ণ ও মহাভারত। তাঁরই পুত্র সুকুমার রায় হলেন কিশোর বয়সের জুড়িহীন লেখক। তাঁর গল্পের বই পাগলা দাশু আর হযবরল দ্রুত পড়ে নিয়ো। লীলা মজুমদারও আরেক কীর্তিমান লেখক, তাঁর সাহিত্যেরও নব্বই ভাগই ছোটদের জন্য। এর মধ্যে দিন দুপুরে এবং বাতাসবাড়ি পড়তে ভুলো না। হুমায়ুন আজাদের লাল নীল দীপাবলি, কতো নদী সরোবর, ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না এবং বুকপকেটে জোনাকিপোকা যেমন পড়বে, তেমনি পড়বে মুহাম্মদ জাফর ইকবালের হাতকাটা রবিন ও দীপু নাম্বার টু এবং হুমায়ূন আহমেদের তোমাদের জন্য রূপকথা, তোমাদের জন্য ভালোবাসা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রামের সুমতি, বিন্দুর ছেলে এবং শ্রীকান্ত প্রথমভাগ; বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আম আঁটির ভেঁপু ও চাঁদের পাহাড়; জসীম উদ্দীনের বাঙ্গালীর হাসির গল্প (যদিও সাধু ভাষায়); একটু বড় হলে অবশ্যই পড়বে অন্নদাশংকর রায়ের পথে প্রবাসে, সৈয়দ মুজতবা আলীর দেশেবিদেশে এবং তাঁদের অন্যান্য লেখা।
তালিকা আরও দীর্ঘ করা যায়, কিন্তু লেখা তো এক জায়গায় থামাতে হয়। তাই আপাতত থামলুম।