২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

আমার বাসার কাছেই ছিল হিজবুল্লাহর হাসান নাসরুল্লাহর আস্তানা

লেবাননের বিভিন্ন এলাকায় হামলা চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। গত ২৭ সেপ্টেম্বর রাজধানী বৈরুতে বিমান হামলার মুখে পড়েছিলেন প্রবাসী এক বাংলাদেশি। তাঁর মুখে শুনুন সেই অভিজ্ঞতা। নিরাপত্তার কারণে তাঁর নাম গোপন রাখা হলো।

লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ইসরায়েলের বিমান হামলা
ছবি: রয়টার্স

বৈরুতে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করি প্রায় এক যুগ। কত ঘটনার সাক্ষী। লেবাননের সীমান্ত অঞ্চলে প্রায়ই ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার খবর পাই। গণমাধ্যমে সেসব খবর দেখে রাজধানীতে বসেও খুব ভয়ে ভয়ে থাকি। ২০২০ সালে আমাদের অফিসের পাশেই আত্মঘাতী বোমা হামলা হয়েছিল। এসব নিয়ে ঢাকায় পরিবারের সদস্যরা সব সময় উৎকণ্ঠায় থাকে। আমরাও যে খুব নির্ভার থাকি, এমন নয়। তবে আগে যেটা ছিল দূরের যুদ্ধ, সেটাই এবার আশপাশে দেখছি।

অফিস থেকে ১৫ মিনিটের দূরত্বে বৈরুতের দক্ষিণে শহরতলিতে থাকি। যুদ্ধাবস্থা চলছে বেশ কয়েক মাস। তাই দেখেশুনে চলি, সতর্ক থাকি। গত মাসে বিভিন্ন জায়গায় পেজারসহ মোবাইল, ল্যাপটপে বিস্ফোরণে অনেকে হতাহত হন। এ ঘটনার পর থেকে চিন্তা আরও বেড়ে গেছে। মোবাইল ব্যবহার করতেও এখন ভয় লাগে। এর মধ্যেই ২৭ সেপ্টেম্বর বৈরুতসহ লেবাননের বিভিন্ন জায়গায় বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। হামলার আগেই অবশ্য ইসরায়েলের পক্ষ থেকে সতর্কবার্তা জারি করে বলা হয়েছিল—বেসামরিক নাগরিকেরা যেন হিজবুল্লাহ–অধ্যুষিত এলাকা ছেড়ে চলে যায়।

আরও পড়ুন

আমি যে এলাকায় থাকি, সেটা ইসরায়েলের ঘোষিত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মধ্যে পড়ে। সতর্কবার্তা জারির পর বাসা ছেড়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। অফিস থেকে দিনের কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় বাসায় যাই। ভেবেছিলাম, জামাকাপড় গুছিয়েই বেরিয়ে যাব। একটা তিনতলা ভবনের নিচতলায় আমার রুম। কিন্তু বাসায় ঢোকার পরই শুরু হয় বোমা হামলা। একের পর এক বিস্ফোরণ। আকাশে চক্কর দিতে থাকে যুদ্ধবিমান। বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড়। মুহুর্মুহু ভবনটা এমনভাবে কেঁপে উঠছিল, মনে হচ্ছিল এখনই ধসে পড়বে। হতবিহ্বল হয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ি।

মেঝেতে শুয়ে থাকতে থাকতেই একসময় বিস্ফোরণের শব্দ থেমে যায়। বাইরে মানুষের কথাবার্তা শুনতে পাই। বুঝতে পারি, বিমান হামলা থেমেছে। কিন্তু তারপরও মনে হয়, এই বুঝি বোমা পড়বে। তারপর মেঝে থেকে উঠে জামাকাপড় নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসি। পথে দেখি মানুষের আর্তনাদ। অনেকে ছোটাছুটি করছে। কেউ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য অন্যত্র চলে যাচ্ছে। কেউ কেউ আবার বেরিয়েছে হামলার ক্ষয়ক্ষতি দেখতে। তবে সবার চোখেমুখে ভয়, বাঁচার আকুতি।

এ দিকটা হিজবুল্লাহশাসিত অঞ্চল। সে কারণে সরকারি বাহিনীর তৎপরতা কম। বিমান হামলার পরও আইনশৃঙ্খলা বা সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতি চোখে পড়ল না।

সম্প্রতি ইসরায়েলের বিমান হামলায় হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ মারা গেছেন
ছবি: এএফপি

রাতে আবারও হামলা হতে পারে, এই আশঙ্কায় প্রথমে বৈরুতের সুন্নি–অধ্যুষিত এলাকায় চলে যাই। এখানেও দিন কয়েক আগে হামলা হয়েছে। মনে হলো, রাতে যে হামলা হবে না, তার কী নিশ্চয়তা! মোটরসাইকেল নিয়ে বেরিয়েছিলাম। এবার বাইক স্টার্ট দিয়ে শহর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরের খ্রিষ্টান–অধ্যুষিত এলাকায় চলে যাই। মনে হচ্ছিল, এই জায়গাটা মোটামুটি নিরাপদ। সেখানেই আশ্রয় নিই।

কিছুটা নিরাপদে আসার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখি, বিমান হামলায় লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রধান নেতা হাসান নাসরুল্লাহ মারা গেছেন। আশপাশের মানুষও বিষয়টা বলল। এর মধ্যেই জানতে পারলাম, হামলায় বাংলাদেশের একজন নাগরিকও মারা গেছেন। আহত হয়েছেন বেশ কয়েকজন।

হাসান নাসরুল্লাহর আস্তানার তথ্য জেনে বিস্মিত হলাম। আমার বাসা থেকে তাঁর আস্তানা কাছেই ছিল। একটি বহুতল ভবনের ভূগর্ভস্থ বাংকারে থাকতেন বলে জানতে পারলাম। তিনি এখান থেকে গোপন বৈঠক করতেন, বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করতেন। নিরাপত্তার কারণে কখনো প্রকাশ্যে আসতেন না। আমার এক যুগের বৈরুতবাসে তো দেখিইনি, এখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে যাঁদের বয়স ৩০ থেকে ৩৫ বছর, তাঁদের সঙ্গেও কথা বলেছি, তাঁরাও কোনো দিন তাঁকে দেখেননি।

লেবাননে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েল। ট্যাংকসহ সামরিক উপস্থিতির ছবিটি ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের
ছবি: এএফপি

লেবাননে ইসরায়েলের স্থল অভিযান শুরু হয়েছে। বর্তমানে ইসরায়েলি হামলা কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ নেই। আজও (৩ অক্টোবর) বৈরুতে ইসরায়েলি হামলা হয়েছে। দেশটিতে অবস্থানরত বাংলাদেশের নাগরিকদের নিরাপদে থাকার পরামর্শ দিয়েছে বৈরুতে বাংলাদেশ দূতাবাস। অনেকে সমস্যার মুখোমুখি হলে দূতাবাসে যোগাযোগ করছেন। আমি দুই দিন দুই জায়গায় গিয়ে ত্রাণ পৌঁছে দিয়ে এসেছি।

লেবাননের নাগরিকসহ এখানে যাকেই দেখা পাচ্ছি, সবার মধ্যে আতঙ্ক। অনেকে জরুরি মুহূর্ত ছাড়া মোবাইল ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকছেন। পেজার বিস্ফোরণের ভয়ে। এমন মৃত্যুশঙ্কা নিয়ে আরও কত দিন থাকতে হবে কে জানে!