মা–বাবার বিষণ্নতা যেভাবে সন্তানের জন্য ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনতে পারে
সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে মায়ের আত্মহত্যা, সন্তানকে হত্যার পর বাবার আত্মহত্যা, বাংলাদেশেও এমন খবর এখন বিরল নয়। এসব ঘটনা আমাদের স্তব্ধ করে, গভীর শোক ও উদ্বেগের মুখে ঠেলে দেয়। স্বাভাবিক চিন্তার যেকোনো মানুষের কাছে এমন কর্মকাণ্ড শুধু হৃদয়বিদারকই নয়, অযৌক্তিক, নিষ্ঠুর ও দুর্বোধ্য। এমন ঘটনা কাম্য নয়, কোনোমতেই মেনে নেওয়ার নয়, কিন্তু ঘটছে। কেন ঘটছে, এর পেছনের আর্থসামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক কারণগুলো জানা থাকলে উত্তরণ কিছুটা হলেও সহজ হতে পারে।
সম্ভাব্য কারণ
১. মানসিক অসুস্থতা: কিছু মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি স্বাভাবিক ও যৌক্তিকভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, বাস্তবতাকে নেতিবাচক ও বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করে। তাদের মধ্যে আত্মহত্যা বা সন্তান থাকলে তাকে সঙ্গে নিয়ে আত্মহত্যার ঝুঁকি থাকতে পারে। এসব মানসিক রোগের মধ্যে উচ্চ মাত্রার বিষণ্নতা অন্যতম। এ ছাড়া রয়েছে বাইপোলার ডিজঅর্ডার বা সাইকোসিস, মাদকাসক্তি, মায়েদের মধ্যে প্রসব-পরবর্তী বিষণ্নতা।
২. কষ্ট থেকে নিজেকে ও সন্তানকে বাঁচাতে হত্যা: মরে গিয়ে বেঁচে যাওয়ার চেষ্টা! কষ্ট থেকে বাঁচার জন্য সন্তানসহ নিজেকে হত্যা! অদ্ভুত শোনালেও উচ্চ মাত্রার বিষণ্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে এমন চিন্তা আসতে পারে। একদিকে শারীরিক ও মানসিক শক্তিহীনতা, আরেক দিকে মস্তিষ্কের সমস্যা সমাধানকারী অংশের নিষ্ক্রিয়তা আক্রান্ত ব্যক্তিকে তীব্র মনোযাতনায় ফেলে দেয়, যা ধীরে ধীরে জীবনবিধ্বংসী চিন্তা ও সিদ্ধান্তের দিকে মোড় নেয়।
৩. সামাজিক প্রতিকূলতা: কিছু প্রতিকূলতা যেমন আর্থিক সংকট, দাম্পত্য কলহ, বিচ্ছেদ, বেকারত্ব, বৈষম্য, নির্যাতন, দুর্ঘটনা ইত্যাদি মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তির হতাশা ও বিষণ্ণতাকে বাড়িয়ে তোলে। এমন পরিস্থিতিতে ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি অসহায় ও নিরুপায় বোধ করে, যা তাকে ধ্বংসাত্মক সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যায়।
৪. সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: সামাজিক সহযোগিতার অভাব মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তির একাকিত্ব ও হতাশার অনুভূতিকে তীব্রতর করে। সামাজিক সহায়তা বিভিন্ন ধরনের হতে পারে, যেমন আর্থিক সহায়তা যা মূলত পরিবার, বন্ধু, আত্মীয়স্বজন বা দাতব্য সংস্থা থেকে আসতে পারে; মানসিক সহায়তা যেমন কঠিন পরিস্থিতিতে কাছের মানুষকে পাশে পাওয়া, যত্ন ও মমতা পাওয়া; ব্যবহারিক সহায়তা যেমন দৈনন্দিন কাজকর্মে সহযোগিতা, বাজার বা গৃহস্থালি কাজে সাহায্য এবং তথ্যসহায়তা যেমন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া। মানসিক রোগে আক্রান্ত বা ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি যখন পর্যাপ্ত সামাজিক সহযোগিতা থেকে বঞ্চিত থাকেন, তখন তাঁর মধ্যে সন্তানসহ নিজেকে শেষ করে দেওয়ার মতো ধ্বংসাত্মক চিন্তা আসতে পারে।
৫. মানসিক স্বাস্থ্যসচেতনতার অভাব: কাউন্সেলিং বা মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আমাদের সমাজে বেশ কিছু মিথ বা ধারণা চালু আছে, যা মানুষকে সাহায্য নেওয়া থেকে পিছপা করে। চিকিৎসা নিতে দেখলে লোকে আমাকে পাগল বা মানসিক রোগী ভাববে, এমন ভীতি থেকে অনেকেই পেশাদার মনোবিদের শরণাপন্ন হন না, ফলে মানসিক সমস্যা বাড়তে থাকে। একসময় যা আত্মঘাতী বা হত্যাকাণ্ডের প্রবণতায় রূপ নিতে পারে।
লক্ষণ ও সতর্ক সংকেত
আত্মহত্যা বা হত্যাকাণ্ডের সিদ্ধান্ত নিতে পারে, এমন ব্যক্তির আচরণ ও কথাবার্তা থেকে বেশ কিছু সংকেত পাওয়া যায়। আমরা যদি সেসব সংকেত বা লক্ষণ সম্পর্কে সজাগ থাকি, তাহলে খুব সহজেই ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তিকে সহযোগিতা দিতে বা চিকিৎসা নিতে উদ্যোগ নিতে পারি।
লক্ষণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো—
১. ব্যর্থতার বহিঃপ্রকাশ: নিজেকে বোঝা হিসেবে দেখা। নিজেকে ও সন্তানদের অপ্রয়োজনীয় মনে করা।
২. সামাজিক সম্পর্ক ছিন্ন করা: বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেওয়া, বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া।
৩. নিজের জিনিসপত্র বিলিয়ে দেওয়া: আর্থিক বিষয়াদি গুছিয়ে নেওয়া, জিনিসপত্র বিলিয়ে দেওয়া ইত্যাদি কাজ আত্মঘাতী ইচ্ছাকেই ইঙ্গিত করে।
৪. ঘন ঘন মৃত্যু নিয়ে কথা বলা: মরে গেলেই ভালো, এমন চিন্তাধারা ও কথাবার্তা বা মৃত্যুকে একমাত্র মুক্তি বা সমাধানের পথ মনে করা।
৫. আচরণগত পরিবর্তন: হঠাৎ শান্ত ও চুপ হয়ে যাওয়া, কাজকর্ম থামিয়ে দেওয়া বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হওয়া, ধীরগতিতে চলাফেরা ও কথাবার্তা বলা ইত্যাদি।
প্রতিরোধ ও পদক্ষেপ
এমন ট্র্যাজেডি প্রতিরোধে সচেতনতা, সময়মতো পদক্ষেপ এবং সামাজিক সহায়তার ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। কিছু সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ হতে পারে—
১. মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানো: মানসিক স্বাস্থ্য ও স্বাস্থ্যসেবা সম্পর্কে বিভ্রান্তি দূর করতে সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মক্ষেত্রে মানসিক স্বাস্থ্যকে প্রাধান্য দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যখন মানসিক স্বাস্থ্য প্রাধান্য পায়, নিষ্ঠুরতা, নিপীড়ন, বৈষম্যও তখন কমে আসে। পরস্পরের জন্য নিরাপদ ও আস্থাশীল হয়ে ওঠে মানুষ। এতে করে ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তির জীবন যেমন সহজ হয়, তেমনি নতুন করে আর কেউ ঝুঁকির মুখে পড়ে না। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে গণমাধ্যমের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
২. মা-বাবা বা অভিভাবকদের জন্য সামাজিক সহায়তা: সন্তান লালন-পালনের বিষয়টি উপভোগ্য হলেও কঠিন একটি দায়িত্ব। মানসিক চাপ কমাতে এ সময় আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক সংযোগও বেশ প্রয়োজন হয়। সন্তান পালনের কঠিন এই যাত্রাপথে সামাজিক সহায়তাহীন ও একা বোধ করলে মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে। নিরাপদ কর্মস্থল, সামাজিক সহযোগিতাপূর্ণ পরিবেশ মা-বাবা বা অভিভাবকের মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকাংশেই কমাতে পারে।
৩. মানসিক স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা: মানসিক স্বাস্থ্যসেবাকে সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করার জন্য সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর পদক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ।
৪. জরুরি মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা: বিভিন্ন হাসপাতালে যেমন জরুরি বিভাগ রয়েছে, যেখানে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা পাওয়া যায়, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও এমন জরুরি সেবা প্রয়োজন হয়, যেখানে আক্রান্ত ব্যক্তি তাৎক্ষণিক সেবা পেতে পারে।
সন্তানকে হত্যা করার পর আত্মহত্যা করা বিষণ্নতাজনিত মানসিক অসুস্থতার ভয়ংকরতম রূপগুলোর একটি। এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধে সামগ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন, পারস্পরিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।