প্রসাধনপণ্যে আস্থা বাড়াচ্ছে যেসব দেশি ব্র্যান্ড
নিজের যত্ন বা সৌন্দর্যচর্চায় আগ্রহ দিন দিন বেড়েই চলেছে। ত্বক বা চুলের যত্নকে এখন ধরা হয় শরীরের যত্নের অংশ হিসেবেই। কারও কারও কাছে তো এটা ‘রিচ্যুয়াল’ বা আচারের মতোই। এ জন্য বিশ্বজুড়ে সৌন্দর্যপণ্য বিশেষ করে ত্বক ও চুলের যত্নের পণ্যের বাজার বেড়েই চলেছে। প্রতিনিয়ত আসছে নতুন নতুন পণ্য। বাংলাদেশের সৌন্দর্যপণ্যের বাজারও কিন্তু এর বাইরে নয়। আমাদের দেশের বাজারেও সারাক্ষণ একরকমের ইঁদুরদৌড় চলে। আর এটি বিদেশি বনাম দেশি পণ্যের। এই মুহূর্তে এসে বেশ আনন্দের সঙ্গেই বলা যায়, আমাদের বেশ কটি স্থানীয় প্রতিষ্ঠান আছে যাদের কারণে সৌন্দর্যপণে৵র বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান বেশ পোক্ত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানী (বাংলাদেশ) লিমিটেড, স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেড, মৌসুমি ইন্ডাস্ট্রিজের কথা বলতে হয়। যোগ করতে হয় ন্যাচুরা কেয়ারের নামও।
দেশের সবচেয়ে পুরোনো প্রসাধনী উৎপাদক কোহিনূর কেমিক্যাল কোম্পানী এখনো দাপটের সঙ্গে টিকে আছে। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৯৫৬ সালে। বিদেশে কোনো ব্র্যান্ডের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও বিক্রীত একটি বা দুটি পণ্য থাকে, যেগুলোকে ‘নায়ক (হিরো প্রোডাক্ট)’ বলা হয়। কোহিনূর কেমিক্যালের এমন পণ্য একাধিক। সেগুলো হলো তিব্বত পমেড, তিব্বত স্নো, স্যান্ডালিনা স্যান্ডাল সোপ। ৬৮ বছর ধরে টিকে থাকার অন্যতম কারণ, তারা সব সময় সাধারণ ভোক্তার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে মানসম্মত পণ্য বাজারজাত করা নিশ্চিত করেছে।
বলতেই হবে স্কয়ার টয়লেট্রিজের কথা। বাজারে তাদের স্কিনকেয়ার ও হেয়ারকেয়ার পণ্যের চাহিদা আকাশচুম্বী। এর মধ্যে এগিয়ে আছে মেরিল রিভাইভ লাইনের বডি লোশন, শ্যাম্পু, সানব্লক পাউডার, মেরিল গ্লিসারিন, মেরিল পেট্রোলিয়াম জেলি ইত্যাদি। বৈশ্বিক বাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তাদের পণ্যের বৈচিত্র্য ও পণ্যের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। স্কয়ার টয়লেট্রিজের একটি সুন্দর ও গোছানো ওয়েবসাইট আছে, যেখানে গেলে সব পণ্যের বর্ণনা পাওয়া যায়। এগুলো তৈরিতে ব্যবহৃত উপাদানের তালিকা, উপকারিতা ও ব্যবহারবিধি জানা যায়। নতুন প্রজন্মের সচেতন ভোক্তাদের টানার জন্য এই ওয়েবসাইট বেশ ভালো ভূমিকা রাখছে।
স্কয়ার টয়লেট্রিজ লিমিটেডের প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) মালিক মোহাম্মদ সাঈদ বলেন, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পণ্যে বৈচিত্র্য আনা হয়েছে। এখানে আলাদা করে বলতে হবে নতুন ‘মায়া ন্যাচারালস’ প্রোডাক্ট লাইনের কথা। এতে আছে ভেষজ উপাদানে তৈরি ফেস অয়েল ও হেয়ার অয়েল। সাধারণত আমাদের বেশির ভাগ কাঁচামাল দেশের বাইরে থেকে সরাসরি উৎপাদকের কাছ থেকে আনা হয়। তবে মায়া ন্যাচারালসের পণ্য তৈরিতে ব্যবহৃত বেশ কিছু ভেষজ উপাদান নিজস্ব কারখানায় নিজেদের তত্ত্বাবধানে এক্সট্রাক্ট করা হয়। গুণগত মান নিশ্চিতের জন্য একেকটি পণ্য তৈরিতে স্কয়ার টয়লেট্রিজ দেশি-বিদেশি ফাইটোকেমিস্টদের দিয়ে প্রয়োজনীয় গবেষণা ও ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের ব্যবস্থা করে থাকে।’
মালিক মোহাম্মদ সাঈদ জানান, শিগগিরই স্কয়ার টয়লেট্রিজ আন্তর্জাতিক মানের মেডিকেটেড স্কিনকেয়ার ও হেয়ারকেয়ার পণ্য উৎপাদন করে বাজারে আনতে চলেছে।
প্রসাধন বাজারে দেশের আরেকটি ব্যবসাসফল প্রতিষ্ঠান হলো মৌসুমি ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। তাদের ‘হিরো’ ব্র্যান্ড কিউট। শীতকালে এখনো অনেক মানুষের ত্বকের যত্নে ভরসা কিউট কোল্ড ক্রিম। এটি ছাড়াও তাদের রয়েছে পমেড, পেট্রোলিয়াম জেলি, লিপ জেল ও গ্লিসারিন।
প্রসাধনীর বাজারে ন্যাচুরা কেয়ারের যাত্রা খুব বেশি দিনের না হলেও এরই মধ্যে তারা বেশ নাম করেছে। তাদের আছে স্কিনকেয়ার, বডিকেয়ার ও হেয়ারকেয়ার পণ্য। সংখ্যাটা যদিও কম, তবে চাহিদা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। তাদের পণ্যগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ন্যাচুরা ক্লিয়ার অ্যান্ড গ্লো ফেসওয়াশ, ন্যাচুরা গ্রো হেয়ার অয়েল, শ্যাম্পু, ন্যাচুরা ফ্রেশ বডিওয়াশ।
রাজধানীর বেশ কিছু বিপণিবিতান ঘুরে দেখা যায়, মিলেনিয়াল বা জেন-জি এই দুই প্রজন্মের অনেকেই ত্বক ও চুলের যত্নে দেশি পণ্যে ভরসা রাখেন। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে তার প্রমাণ পাওয়া গেল।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহকারী সচিব সাদমান সাকিব (২৮) বলেন, ‘ছোটবেলায় বাবাকে দেখেছি কুল শেভিং ক্রিম ব্যবহার করতে। আমিও প্রথমে ওটা দিয়ে শুরু করি। এর মধ্যে অনেক বিদেশি শেভিং ফোম ব্যবহার করেছি; কিন্তু কেন জানি ওগুলো আমার মন ভরাতে পারেনি। এখন আবার কুলে ফিরে এসেছি। এর পাশাপাশি ব্যবহার করছি কিউট আফটার শেভ লোশন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মানহা তাবাসসুম (২১) শীত এলে অতিরিক্ত শুষ্ক ত্বকের সমস্যায় ভোগেন। অনলাইনে আন্তর্জাতিক বিউটি ইনফ্লুয়েন্সারদের কনটেন্ট দেখে তিনি অনেক ট্রেন্ডি ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করে কোনো সুফল পাননি। তিনি বলেন, শেষমেশ মায়ের কথা শুনে তিব্বত পমেড ব্যবহার করি। আর আমার মনে হয় না আমি কখনো এটা ব্যবহার করা বন্ধ করব।’
ব্যাংক কর্মকর্তা নাজমুল হাসিব (৩২) ত্বকের যত্নে ছোটবেলা থেকেই দেশি পণ্য ব্যবহার করে আসছেন। কথায় কথায় জানান, গরমে আমার ঘামাচির সমস্যা হয়। আগে মিল্লাত ঘামাচি পাউডার ছিল আমার ভরসা। এখন এটা খুব একটা পাওয়া যায় না দেখে তিব্বত ঘামাচি পাউডার ব্যবহার করি। এর মানও অনেক ভালো।’
প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রভাবিত মিলেনিয়াল ও জেন-জিদের মধ্যে বৈশ্বিক চলতি ধারার খোঁজখবর রাখার প্রবণতা অনেক বেশি। তবুও তাঁদের মধ্যে দেশি সৌন্দর্যপণ্য ব্যবহারের আগ্রহ অনেক বেশি। এটি সম্ভব হয়েছে ব্র্যান্ডগুলোর স্বচ্ছতা ও গুণগত মান নিশ্চিত করার ব্যাপারে সচেতন থাকার কারণে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রসাধন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলোও বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে নিজেদের সময়োপযোগী করে তুলছে। বলা যায়, একদিন ঠিকই বৈশ্বিক সৌন্দর্যপণ্যের বাজারে আমাদের দেশি পণে৵র একটা শক্ত অবস্থান গড়ে উঠবে।