একজন ভুল মানুষ তোমার পুরো জীবনটা ওলট–পালট করে দিতে পারে: নুসরাত ফারিয়া
ভারতের গুজরাটের পারুল ইউনিভার্সিটির সমাবর্তন অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন অভিনেত্রী নুসরাত ফারিয়া। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে দারুণ এক বক্তৃতাও দিয়েছেন তিনি। পড়ুন ইংরেজিতে দেওয়া সেই বক্তৃতার বাংলা অনুবাদ।
অভিনন্দন স্নাতকেরা। এই মিলনায়তন, সমাবর্তন, সমাবর্তনে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের দেখে বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছি। কারণ, সমাবর্তনের অভিজ্ঞতা আমার নেই, যদিও আমি আইনে স্নাতক।
পারুল বিশ্ববিদ্যালয়কে অসংখ্য ধন্যবাদ। সেই সুদূর বাংলাদেশের ঢাকা থেকে আমি এসেছি তোমাদের দেখব বলে, তোমাদের এই দারুণ সময়টার অংশ হব বলে। সকাল থেকে তোমাদের নানা আয়োজন দেখে আমি সত্যিই বেশ রোমাঞ্চিত। আমারই গানের সঙ্গে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের নাচ, বিভিন্ন দেশের ছাত্রছাত্রীদের নিজস্ব পরিবেশনা, সবই মুগ্ধ হয়ে দেখেছি।
আমার গল্পটা শুরুর আগে নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে চাই। কারণ জানি, তোমাদের অনেকের কাছেই আমি অপরিচিত। আমি বাংলাদেশের মেয়ে। নাম নুসরাত ফারিয়া। বয়স ২৮। ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে আইনের স্নাতক। আমি একজন অভিনয়শিল্পী, উপস্থাপক, মডেল ও নৃত্যশিল্পী। তোমাদের সামনে উপস্থাপনের মতো তেমন কোনো বক্তৃতা আজ তৈরি করে আসিনি। শুধু নিজের গল্পটাই বলব।
৫০০ টাকায় উপস্থাপনা
১৬ বছর বয়স থেকে কাজ শুরু করি। মনে আছে যখন স্কুলে পড়তাম, ক্লাসের চেয়ে স্কুলের মিলনায়তনেই সময় কাটত বেশি। বিতর্ক, নাচ, গানে এতই মশগুল থাকতাম যে ক্লাসে হাজিরা দেওয়ার সময় কোথায়! তাই বলে এ প্লাস কিন্তু হাতছাড়া হতো না কখনোই। বলতেই হয়, আমি নিশ্চয়ই খুব মেধাবী ছিলাম।
মধ্যবিত্ত একটা পরিবারে আমার বেড়ে ওঠা। তাই দ্বাদশ শ্রেণি পেরোনোর পর মা বললেন, তোমার সামনে দুটি পথ আছে। হয় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ো, নয়তো পড়ালেখা ছেড়ে দাও। সেই সময় থেকেই উপস্থাপনার মতো টুকটাক কাজ শুরু করি। সে সময় উপস্থাপনার জন্য ৫০০ টাকা, অর্থাৎ তোমাদের দেশের ৫০০ রুপি করে পেতাম। দিনে তিন থেকে চারটি অনুষ্ঠানেও উপস্থাপনা করতাম, যেন হাতখরচটা মোটামুটি উঠে আসে, সেই সঙ্গে কিছু টাকাও জমাতে পারি। জমানো টাকায় হয়তো পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পারব।
২০১৩ সালে আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশে (এআইইউবি) ভর্তি হই। কিন্তু সেশন ফি এতই বেশি ছিল যে ছয় থেকে সাত মাস পরই বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে দিতে হয়। এরপর ২০১৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি দিন আমি কাজ করে গেছি, চলচ্চিত্রশিল্পী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছি। একটু একটু করে টাকা জমিয়েছি। ২০১৭ সালে ইউনিভার্সিটি অব লন্ডনের ঢাকা ক্যাম্পাসে ভর্তি হই, আইন বিভাগে। নাচ, গান, অভিনয়, তারকাজগতের ঝলমলে জীবনকে পাশে নিয়ে পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া সহজ কথা নয়। সম্ভব হয়েছে, কারণ আমি সব সময় আইনজীবী হতে চেয়েছিলাম।
সদয় হও
১১ বছরের ক্যারিয়ারে একজন নারী হিসেবে আমাকে নানা বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়েছে। বাংলাদেশের মতো একটা রক্ষণশীল দেশে তুমি যখন প্রচলিত ধারণা ভাঙতে চেষ্টা করবে, সেটা আরও কঠিন। আমার অভিনয়, নাচ, গানে সব সময় সেই চেষ্টাই করেছি। এ কারণেই সম্ভবত ২০১৯ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনীমূলক ছবিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চরিত্রের জন্য আমাকে নির্বাচন করা হয়। এটা আমার পেশাজীবনের একটা বড় মাইলফলক।
কিন্তু এই পুরো যাত্রার অভিজ্ঞতা থেকে একটা জিনিস শিখেছি—সদয় হওয়া, সহানুভূতিশীল হওয়ার চেয়ে বড় কিছু নেই। আজ যে পাশে বসে আছে, এই ঘর থেকে বের হওয়ার পরই হয়তো আর কোনো দিন তার সঙ্গে তোমার দেখা হবে না। কিন্তু তবু একে অপরের প্রতি সহানুভূতিশীল থাকো।
আজ যদি ভাবো, আমি স্নাতক হয়ে গেছি, ব্যস! আর কী চাই! না সুপ্রিয় ভদ্রমহিলা ও ভদ্রমহোদয়গণ, তা নয়! জীবনের মাত্র শুরু। ক্লাসে হয়তো তুমি সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছ। তার মানে এই নয় যে জীবনেও সফল হবে। আবার তুমি হয়তো ক্লাসে সবচেয়ে কম নম্বর পেয়েছ, কিন্তু তোমারও সফল হওয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে; যদি নিজের ওপর বিশ্বাস রাখো।
দুই প্রশ্ন
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আয়নায় তাকিয়ে নিজেকে দুটি প্রশ্ন করি—
১. আজ আমি কেমন আছি?
২. আজ আমি কী হতে চাই?
আমি কি আজ ভালো আছি? আমি কি আজ মানুষের প্রতি সদয় হব, নাকি নেতিবাচক ভূমিকায় যাব?
নিশ্চিত কোরো, দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে যেন সব সময় বলতে পারো, আজ আমি সদয় থাকব। এই ২০২৪ সালে এসে আমাদের সবার জীবনটাই বড় অস্থির। সবার হাতে ফোন আছে। আমরা প্রতিনিয়ত নানা তথ্য পাচ্ছি। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক স্ক্রল করছি। মাথাটাকে তথ্যে ভারাক্রান্ত করে ফেলছি। এত সব তথ্য থেকে তুমি যেন ঠিক তথ্যটা গ্রহণ করে বাকিগুলো ঝেড়ে ফেলতে পারো, ভালোটাকে গ্রহণ করে খারাপটা বর্জন করতে পারো, এটা নিশ্চিত কোরো। ঠিক পথে থাকাটা জীবনে খুব জরুরি, সেটা যেভাবেই হোক।
আজকে তোমাদের মাঝখানে এসে আমি ভীষণ খুশি। কারণ, আমি কখনো সমাবর্তন পাইনি। তোমার ভাগ্যবান, তোমরা পাচ্ছ। এত ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছ। এত গণ্যমান্যজন আজ তোমাদের সঙ্গে আছেন। এই পাওয়াটাকে জীবনে কাজে লাগিয়ো।
কঠোর পরিশ্রমের বিকল্প কিছু নেই। এটা মনে প্রাণে গেঁথে নাও, একদম মুখস্থ করে নাও। তুমি কতটা সৌভাগ্যবান, কতটা সুবিধাভোগী, কতটা মেধাবী, কোনো কিছুতেই কিছু যায় আসে না। যদি কঠোর পরিশ্রম করো, ওপরওয়ালা ঠিকই তোমাকে চমকে দেবেন। তোমাদের জীবনে কী কী চমক আসে, দেখার অপেক্ষায় রইলাম। তোমাদের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা।
সবাই খুব গম্ভীর মুখ করে বসে আছে। পরিবেশটা একটু হালকা করার জন্য সব শেষে আরেকটা কথা বলি, জীবনে ঠিক মানুষটাকে ভালোবেসো। একজন ভুল মানুষ তোমার পুরো জীবনটা ওলট–পালট করে দিতে পারে। ঠিক? অতএব এমন মানুষকেই ভালোবেসো, যে তোমাকে তোমার সেরা অবস্থানে পৌঁছতে সাহায্য করবে।