পড়েছেন অণুজীববিজ্ঞানে, সফলতা পেলেন ইয়োগা প্রশিক্ষণে
ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে দোলনায় বসে আছেন বাবা। ‘গীতবিতান’ খুলে পড়ে শোনাচ্ছেন, বোঝাচ্ছেন গানের অর্থ। দেখাচ্ছেন জোনাকি, বলছেন কীভাবে জোনাকি আলো ছড়ায়, অন্যকে পথ দেখায়। বাবার শেখানো সেই সব কথা ভোলেননি মেয়ে। তিনি এখন কাজ করেন অন্যের জীবনমান উন্নয়নে। দ্বিধায় বাঁচা, নেতিবাচক চিন্তার মানুষদের ইতিবাচকতায় বাঁচতে শেখান। যোগব্যায়াম বা ইয়োগার মাধ্যমে শরীর, মন—দুটিই সুস্থ রাখতে সাহায্য করেন।
বলছি পদ্মশ্রী দের কথা, যিনি লেখাপড়া করেছেন অণুজীববিজ্ঞানের মতো কঠিন বিষয়ে; কিন্তু ভালোবেসেছেন ইয়োগাকে। নিজেকে উন্নত করতে শিখেছেন ইমেজ ডেভেলপমেন্ট। আর নিজের সেই সব জ্ঞান এখন ছড়িয়ে দিচ্ছেন অন্যদের মধ্যে, শেখাচ্ছেন নিজের সবচেয়ে উন্নত সংস্করণে পরিণত হওয়ার কৌশল।
পদ্মশ্রী বেড়ে উঠেছেন সিলেটে। বাবা নিরঞ্জন দে একজন তথ্যচিত্র নির্মাতা, মা জ্যোতি ভট্টাচার্য সিলেট শিল্পকলা একাডেমির আবৃত্তির শিক্ষক। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সিলেটেই লেখাপড়া করেছেন। এরপর তিনি ২০১৬ সালে ভারত সরকারের আইসিসিআর বৃত্তি নিয়ে পড়তে চলে যান বেঙ্গালুরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে স্নাতক শেষ করেছেন অণুজীববিজ্ঞানে, স্নাতকোত্তর করেছেন মানবসম্পদ ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে।
তবে লেখাপড়ার পাশাপাশি শুরু থেকেই শিখেছেন ইয়োগা। করেছেন ইমেজ ডেভেলপমেন্টের কোর্স। ইমেজ ডেভেলপমেন্ট সম্পর্কে জানতে চাইলে পদ্মশ্রী বললেন, এটা হলো এমন একটি বিষয়, যেখানে একজন মানুষের জীবনধারণের প্রয়োজনীয় সবকিছু শেখানো হয়। কীভাবে নিজেকে আরও উন্নত করা যায়, কীভাবে মানুষের সঙ্গে মিশতে হবে, ভালো একটা প্রেজেন্টেশন দিতে হবে, কীভাবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চলতে হবে—সব শেখানো হয়। মোটকথা, ইমেজ ডেভেলপমেন্ট আপনাকে আপনার সবচেয়ে ভালো সংস্করণটি হতে সাহায্য করবে।
দেশে ফিরে সেই ইয়োগা আর ইমেজ ডেভেলপমেন্ট শেখানোর প্রতিষ্ঠানই খুলেছেন পদ্মশ্রী। প্রথমে অনলাইনে কাজ শুরু করলেও এখন সিলেটের মির্জা জাঙ্গালে তাঁর অফিস আছে, যার নাম ‘ট্রিপল এ’। এখানে ইয়োগা, মেডিটেশন, ইমেজ ডেভেলপমেন্ট এবং শিশুদের জন্য স্পোকেন ইংলিশের কোর্স করানো হয়।
অণুজীববিজ্ঞানে পড়ে কেন অন্য পেশা বেছে নিলেন, তা জানতে চাইলে পদ্মশ্রী বলেন, একজন মানুষ যে বিষয়ে লেখাপড়া করবে, সে বিষয়েই তাঁকে পেশা বেছে নিতে হবে—এমন কোনো নিয়ম তো নেই। সবাই মনে করে, লেখাপড়া শেষ করে একটা চাকরি পেলেই বুঝি জীবন সম্পূর্ণ হয়ে গেল। সেটাই বুঝি সফলতা!
কিন্তু আমার কাছে সফলতা হলো সেই কাজে যুক্ত হওয়া, যে কাজ করে মনে শান্তি পাওয়া যায়। মানুষের জন্য কিছু করা যায়। আর সেই চিন্তা থেকেই ‘ট্রিপল এ’র যাত্রা শুরু।
শুধু যে যোগব্যায়াম বা মেডিটেশন নিয়েই ট্রিপল এ কাজ করে, তা নয়। যাঁর যেমন প্রয়োজন, তাঁর জন্য তেমন কোর্স ডিজাইন করা হয়। এ ক্ষেত্রে কারও খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাপনের অভ্যাস বদলানোর প্রয়োজন হলে সে পরামর্শও দেওয়া হয়। একজন মানুষের মানসিক, শারীরিক, ইমোশনাল ও স্পিরিচুয়াল খাত নিয়ে কাজ করে ট্রিপল এ।
ট্রিপল এতে শেখানো হয়, প্রকৃতির প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের কথা, হিংসা–দুশ্চিন্তা কমানোর উপায়, ভালো মানুষ হওয়ার পথ দেখানো হয়। যাঁর জীবনমানের উন্নয়নে যেমন বিষয় যোগ করা প্রয়োজন, সেটাই যুক্ত করে কোর্স ডিজাইন করা হয়। প্রশ্ন ছিল, এই যে একটু অন্যভাবে চিন্তা করা, সেটার পেছনে কোন শক্তি কাজ করেছে?
শুরু থেকেই পরিবারের সব রকম সমর্থন পেয়েছেন পদ্মশ্রী। মা–বাবা কখনোই তাঁর ইচ্ছার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়াননি। তাই এসব করার শক্তি পেয়েছেন, বললেন তিনি।
পদ্মশ্রী বলেন, সব মা–বাবারই উচিত সন্তানের সিদ্ধান্তের ওপর ভরসা রাখা। তাহলে সন্তান তার সেরাটা দিতে পারবে। পদ্মশ্রী আরও বলেন, ‘মানুষের ক্ষমতা অসীম। শিক্ষা তো আলোকিত করার জন্য, সুন্দর ব্যক্তিত্ব তৈরির জন্য। শিক্ষিত হওয়ার সঙ্গে তো বাড়তি গুণের বা শখের কোনো দ্বন্দ্ব নেই।’
জবাবে পদ্মশ্রী বলেন, ভারতে দীর্ঘ সময় আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি হোস্টেলে থেকেছেন তিনি। সেখানে তাঁর সঙ্গী ছিলেন পৃথিবীর ৪৩টি দেশের শিক্ষার্থী, যাঁদের মধ্যে বৃত্তি পাওয়া একমাত্র বাংলাদেশি ছিলেন তিনি। সম্ভবত নানা সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে বাস করতে গিয়ে তাঁর মানসিকতা নতুন গঠন পেয়েছে। এ ছাড়া ছোটবেলা থেকেই মা–বাবাও তাঁকে প্রথাগত অভিভাবকের মতো বড় করেননি। তাঁরা ছিলেন বন্ধুর মতো। সেটিও তাঁকে অবাধে ভাবতে, চিন্তা করতে সাহায্য করেছে।