এখনো মনে হয়, মাঠের ওপাশে হঠাৎ বাবাকে দেখা যাবে

প্রতিবছর জুন মাসের তৃতীয় রোববার পালিত হয় বাবা দিবস। সেই হিসাবে কাল বাবা দিবস। দিনটি উপলক্ষে বাবাকে শ্রদ্ধা জানাতে পাঠকের কাছে লেখা চেয়েছিল ‘ছুটির দিনে’। আমাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে লেখা পাঠিয়েছেন অনেক পাঠক। নির্বাচিত লেখাগুলোর একটি পড়ুন এখানে।

সব মানুষই হয়তো কিছু না কিছু খোঁজে। আমার বাবা সুন্দর শব্দ খোঁজেন। আমার লেখায় আমি সুন্দর শব্দ খুঁজে পাই না; কিন্তু বাবা পান।

একবার আমার একটি কবিতা পড়ে তিনি বললেন, ‘আবাদি মেঘ’ আর ‘অনাবাদি মেঘ’ শব্দবন্ধ দুটি তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে।

আমি বললাম, পছন্দ যখন হয়েছে, নিয়ে নাও।

কিন্তু বাবারা তো নেন না, শুধু দিয়েই যান আজীবন। তাই আকাশে ও রকম মেঘ দেখলেই আমার বাবার কথা মনে পড়ে যায়। একবার বাবা আর তার কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে চাইনিজ খেতে গেছি। তাদের মধ্যে লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে গরম স্যুপ আর অনথন খাচ্ছিলাম। বাবা খেয়াল করে বললেন, ‘এখানে তো তোর কোনো বন্ধু নেই, তাই আমরা গল্প করব আর তুই সব খেয়ে নিবি।’ সবাই হো হো করে হেসে উঠল।

তখন বুঝিনি এ কথার মধে৵ হাসির কী হলো! এখন মনে হয় বন্ধুরা একসঙ্গে হলে হাসির কোনো কারণ লাগে না।

একদিন আমরা পিঠাপিঠি দুই বোন পুকুর পাড়ে বসে আছি। বাবা গোসল করবেন আর আমরা দেখব। কোথায় গেছে সেসব দিন! মনে হয় যেন নাটকের দৃশ্য। বাবার মাথাভর্তি শ্যাম্পুর ফেনা। তিনি চেষ্টা করছেন কীভাবে তা আরও বাড়ানো যায়। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখছি। আপা হাতে পানি নিয়ে পুকুরে ছুড়ে দিচ্ছিল। পানি গোল গোল হীরাখণ্ডের মতো পুকুরের পানিতে গিয়ে পড়ছিল। তাকে দেখে আমিও হীরার টুকরা বানাচ্ছিলাম। আপা হঠাৎ বলল, ‘পানি যত দূর যাচ্ছে তুই কি পারবি তত দূর যেতে?’

আমি কোনো কিছু না ভেবেই বললাম, এটা কোনো বিষয়?

কিন্তু বিষয় হলো, পানিতে দুই পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে। পা পিছলে অনেক দূর চলে গেলাম পানির মধ্যে। সাঁতার জানতাম না তাই পানি খাচ্ছিলাম আর হাত ছুড়ছিলাম।

সেদিন বাবা না থাকলে কী যে হতো!

এ ঘটনার পর তিন দিনের মধ্যে সাঁতার শিখিয়েছিলেন বাবা।

গ্রামে দাদার বাড়িতে বেড়াতে গেলে সাত দিনে অন্তত দুই দিন দাদি সারা রাত পিঠা বানাতেন। আর আমরা ভাইবোনরা ফকফকা চাঁদের আলোয় উঠানে পাটি পেতে গল্প করতাম। চাঁদের আলো যেন গলে গলে আমাদের গায়ে পড়ত। দাদির পিঠা বানানোর আগেই যদি ঘুম চলে আসত, বাবা আমাকে তার কাছে ঘুম পাড়াতেন। তারপর গভীর রাতে জাগিয়ে প্লেটভর্তি গরম পিঠা খেতে দিয়ে তাকিয়ে থাকতেন। এখন আমি পিঠা বানালে আমার ছেলেমেয়ে খুব মজা করে পিঠা খায়, তখন বুঝি কেন বাবা আমাকে পিঠা খেতে দিয়ে মুগ্ধ
হয়ে দেখতেন।

শৈশবে আমাদের বাড়ির সামনে বিরাট মাঠ ছিল। কাজ শেষে বাড়ি ফেরার সময় মাঠের ওপাশে রিকশা থেকে নেমে মাঠটুকু তিনি হেঁটে আসতেন। রোজই কিছু না কিছু নিয়ে আসতেন। আমরা মাঠের ওপাশে বাবাকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে দুই বোন দৌড়াতে শুরু করতাম। চেষ্টা থাকত কে আগে বাবার কাছে পৌঁছাতে পারে। আমি পারতাম না প্রায়ই।

এখনো কোনো মাঠ দেখলে আমার মনে হয়, মাঠের ওপাশে বাবাকে দেখা যাবে হঠাৎ। বিয়ের পর আমি এখন অন্য শহরে থাকি। বাবা-মেয়ের ভালোবাসার গভীরতা অন্য কারও মধ্যে খোঁজা বোকামি। মেয়েরা তাই স্মৃতির ভাঁজে ভাঁজে খোঁজে। গানের মধ্যে খোঁজে। সন্তানের মধ্যে খোঁজে; কিন্তু খুঁজলেই তো পাওয়া যায় না। অর্ধশতাব্দীর জীবনের মধ্যে যেন হাজার বছরের না পাওয়ার কষ্ট লুকিয়ে থাকে।