করলার ফুল আমাকে যা শেখাল

যে কয়বার করলা ফুল দেখেছি, প্রতিবারই অন্য রকম একটা উচ্ছ্বাস বয়ে গেছে মনে
ছবি: লেখকের সৌজন্যে

ছবিটি একটি করলা ফুলের। বাংলাদেশের পথেঘাটে, বাজারে অহরহ করলার দেখা মিললেও মনে হয় না সবজিটির ফুল-পাতার দেখা যেখানে–সেখানে মিলবে। করলা, চিচিঙ্গা, কাঁকরোল, পটোলের মতো সবজিগুলো চাষে বিশেষ মাটি, আবহাওয়া প্রয়োজন। এ অঞ্চলে আঙিনা, টব, বারান্দায় হুটহাট এদের বিস্তৃত ফলন চোখে পড়ে না।

আজকাল অবশ্য ছাদে-বারান্দায় অনেক কিছুই ফলানো সম্ভব হচ্ছে। এ ফুলের সঙ্গে আমার কবে কোথায় কোন বয়সে প্রথম পরিচয় হয়েছিল, ঠিক মনে নেই। কিন্তু যতবারই করলাগাছ-ফুল দেখি, অসম্ভব কিছু একটা সাধন করে ফেলার মতো ভালো লাগায় মনটা ভরে ওঠে।

অনেক বড় বয়সে কোনো এক স্বজনের সবজিবাগানে যখন এক্সপেরিমেন্ট করা চিচিঙ্গাগাছে প্রথমবারের মতো চিচিঙ্গা ফুল আর চিচিঙ্গা ঝুলে থাকতে দেখেছিলাম, কী যে এক অচেনা রকম খুশি আর সুখ লেগেছিল সেদিন। ওই ভালো লাগাটা আর কখনো ম্লান হয়নি। যে রকম কোনো একটা খাবার একবার খেলে তার পেছনের পুরো কোডিংটা আমার সেনসরে স্থায়ীভাবে সংরক্ষিত হয়ে থাকে।

এরপর যে কয়বার চিচিঙ্গা ফুল আর ওই গাছটা দেখেছি, প্রতিবারই অন্য রকম একটা উচ্ছ্বাস বয়ে গেছে, যেমন সকালবেলা জাতীয় সংগীত শুনলে প্রতিবারই মনে হতে থাকে এই প্রথমবার শোনা। কোনো একটা ভালো লাগা সুরের রোদনে ভেতর থেকে সমস্ত জলোচ্ছ্বাস চোখ দিয়ে ডুকরে বের হয়ে আসতে চায়।

আচ্ছা, ফুলে–ফলে ভরপুর ফল–সবজির গাছবাগান দেখলে সবারই কি এমন লাগে? অনেকটা ছোটবেলার গল্পগুলোর সঙ্গে চলা কল্পনাগুলোর মতো নির্মল-প্রাণবন্ত-সমৃদ্ধ! রঙিন টি–শার্ট–ফ্রক পরা হাজার হাজার প্রশ্ন করে যাওয়া নির্ভার-প্রাণোচ্ছল-মায়াময় ছেলেমেয়েদের স্বপ্নগুলোর মতো। আমার তখন শুধু মনে হতে থাকে, ইশ্‌ অনেকগুলো মানুষকে যদি এই ভালো লাগাটা দিতে পারতাম!

যারা ভাবে স্বর্গ অনেক দূর; ভালো থাকতে, সুখী হতে, অনেক কিছু লাগে; যারা ভাবে অন্যকে হারিয়েই আমাকে জিততে হবে, অন্যকে মাড়িয়েই আমাকে দাঁড়াতে হবে, একেকটা ডেঙ্গু-করোনার মতো মহামারি তাদের সুশিক্ষা দেওয়ার জন্য যথেষ্ট হয় না, সত্য বলতে অনুপ্রাণিত করে না। তারা অন্যের খুশিকে নিজের খুশির মতো করে উদ্‌যাপন করতে পারে না।

আমি জানি, অনেকেরই আমার মতো এ রকম মনে হয়, আর যাদের হয় না তাদের দেখার দৃষ্টিটাকে বদলে দেওয়ার প্রয়াসেই হয়তো আমার এই লেখাগুলো লিখতে ইচ্ছা করে! হালের তালে আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে সবাই মিলে যদি মিথ্যার চর্চা শুরু করে দিই, তাতে যেমন মিথ্যা সব সময় মিথ্যাই থাকবে, আবার কেউ একজনও যদি সত্যের চর্চা না করি, তাতেও সত্য চিরদিন সত্যই রয়ে যাবে।

করলায় রয়েছে অনেক ঔষধি গুণ, অনেক অনেকভাবে রান্না করা যায় বলে কীভাবে রান্না হচ্ছে আর কার জন্য রান্না করা হচ্ছে, সেটিও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। বয়স বাড়তে বাড়তে করলা রাঁধতে রাঁধতে বছর বছরের কত যে টক-মিষ্টি-তেতো স্মৃতি আমাদের জমা হয়...জীবনের রংটাই বদলে দিই নিজ হাতে নিজেকে অবিশ্বাস করে। হয়তো দিনে দিনে চারপাশে অর্জিত সাফল্যের ভাঁজ ভেদ করে সেসব গল্প কখনোই আর জনসমক্ষে আলো খুঁজতে আসে না।

ভুল ব্যাকরণে তৈরি শব্দের মালাগুলোও পৃথিবী ঠিক হজম করে নেয় অবিরত আহ্বানে। আর আমরা হয়ে উঠি করলার মতোই ঔষধি গুণে ভরপুর একজন মানুষ। যে মানুষের সব কাজ ও কথার পেছনে একটাই উদ্দেশ্য থাকে—মঙ্গল; নিজের, অন্যের, সবার জন্য মঙ্গল! যেভাবে অনেক মা–বাবাই ব্যাখ্যা দিয়ে তাদের সন্তানদের শেখানোর চেষ্টা করেন, ‘তোমার বন্ধু জিতে গেলে কোনো না কোনোভাবে তুমিও জিতে যাও; তোমরা খুশি হয়ে খেলে বাবা-মায়ের পেট ভরে যায়।’

জীবনের ধর্মই হয়তো ব্যথার নিষ্পেষণে আলোর জন্ম দেওয়া। আমরা যদি সব মানুষ ওই ছোট্ট করলা ফুলটার মতো প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য ও সৌহার্দ্য সংযোগ তৈরি করতে শিখি আর করলার মতো ঔষধি গুণে ভরপুর একেকজন মানুষ হতে পারি! এ পৃথিবীতে কি আর যুদ্ধ কিংবা ওষুধের খুব বেশি প্রয়োজন হবে? রোজ একটা করে তিল জমালেও কয়েক বছরে একটা পাহাড় বা টিলা না হোক, ফলপ্রসূ কাজে লাগার মতো পরিমাণ তিল অবশ্যই জমা হবে।

একইভাবে মানুষের সুখ-দুঃখ, ভালো-লাগা, মন্দ-লাগা, চিন্তা ও কাজগুলোও যত্ন করে সঞ্চয় করা যায়। আমার, আপনার, আমাদের সবার আবেগগুলোই খুব কাছাকাছি, একই বৃন্তে দুটি ফুল মতো। সত্যের পথে হেরে যাওয়া বলে কিছু নেই, প্রতিটি অভিজ্ঞতাই একেকটি রত্ন! কেউ তো জিতে যাবে! বিশ্বাস না হয় পরিকল্পনা করে কয়েকটা বছর একাধারে চেষ্টা করেই দেখুন! পৃথিবীর কোনো না-পাওয়াই আপনাকে, আমাকে, কাউকেই আর ছুঁতে পারবে না...