যানজট কমাতে ‘ট্রাফিক পুলিশ’ শিক্ষার্থীদের ৫ পরামর্শ
প্রায় এক সপ্তাহজুড়ে সারা দেশের ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করেছেন শিক্ষার্থীরা, তা-ও পুলিশের উপস্থিতি ছাড়াই! কদিনের এই অভিজ্ঞতা থেকে দেশের ট্রাফিক–ব্যবস্থার উন্নয়নে কী পরামর্শ দেবেন তাঁরা? রাজধানীর উত্তরা, মতিঝিল, ধানমন্ডি, বাড্ডা, পুরান ঢাকা, যাত্রাবাড়ী, তেজগাঁওসহ নানা জায়গায় যাঁরা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করেছেন, এমন প্রায় ২৫ জন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন মো. সাইফুল্লাহ
১. ট্রাফিক পুলিশের লোকবল বাড়ানো
এই প্রতিবেদন লিখতে গিয়ে যতজন শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা হলো, প্রত্যেকেই স্বীকার করছেন—ট্রাফিক পুলিশের কাজটা যে এত কঠিন, সেটা তাঁরা আগে উপলব্ধি করেননি। জুহি জান্নাত যেমন টানা ৪ দিন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করেছেন উত্তরার ১১ নম্বর সেক্টরের চৌরাস্তা ও কামারপাড়ায়। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস অ্যাগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজির (আইইউবিএটি) যন্ত্রকৌশল বিভাগের এই শিক্ষার্থীর বক্তব্য, ‘আমরা এতজন মিলে কাজ করতে গিয়েও হিমশিম খাচ্ছি। সেখানে অল্প কয়েকজন পুলিশ মিলে কীভাবে এত দিক সামলান, ভাবতেই পারছি না।’
অনেক শিক্ষার্থীর ধারণা ছিল, আমাদের দেশে ট্রাফিক পুলিশ মূলত ট্রাফিক সিগন্যালের বিকল্প হিসেবে কাজ করেন। কিন্তু রাস্তায় নেমে তাঁরা বুঝেছেন, কাজটা শুধুই ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। আইইউবিএটির পুরকৌশলের শিক্ষার্থী সাদিক আবতাহী বলছিলেন, ‘রাস্তায় কোনো ঘটনা ঘটলে সেসব সামাল দেওয়া, কাগজপত্র পরীক্ষা করা, অনেক কাজ। টানা এই কাজ করে যাওয়া খুব কঠিন। আমার যেমন গলা ভেঙে গেছে, এখনো ঠিক হয়নি।’ শিক্ষার্থীরা মনে করেন, ট্রাফিক পুলিশের লোকবল বাড়ানো উচিত। কারও কারও মত, যদি ট্রাফিক পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো সম্ভব না-ও হয়, তাহলে সহায়ক হিসেবে আনসার, এপিবিএনের সদস্যদের কাজে লাগানো যায়। অন্তত কোনো কোনো রাস্তায় রোভার স্কাউট বা বিএনসিসির সদস্যরাও সহায়তা করতে পারেন।
২. অভ্যাসের পরিবর্তন
‘আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে নিয়ম না মানার প্রবণতা যে এত বেশি, আগে জানতাম না।’ আক্ষেপ নিয়েই বললেন বায়জিদ হোসেন। ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজির এই শিক্ষার্থী পুরান ঢাকার দয়াগঞ্জ মোড়ে ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করেছেন। বায়জিদ বলেন, ‘আমরা ছোট গাড়ি, বড় গাড়ি, রিকশা, বাইকের জন্য আলাদা লেন করার চেষ্টা করেছি। একপর্যায়ে দড়ি বেঁধে দিয়েছি। তবু মানুষ নিয়ম মানতে চায় না।’
শিক্ষার্থীরা বলছেন, অধিকাংশ গাড়িচালকই ট্রাফিকের নিয়মকানুন জানেন না। জানলেও উল্টো পথে যাওয়া কিংবা ফুটপাথে উঠে পড়ার মতো ‘ছোটখাটো’ নিয়ম ভাঙাকে তাঁরা ‘অপরাধ’ মনে করেন না। তবে বুঝিয়ে বলে শোনেন। তাই ট্রাফিক–ব্যবস্থার সংস্কার করতে হলে আগে সামগ্রিকভাবে মানুষের অভ্যাস পরিবর্তন করা উচিত বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা। সে জন্য সচেতনতা কার্যক্রম চালানো প্রয়োজন। স্কুল পর্যায় থেকে ট্রাফিকের নিয়মকানুন শেখানো উচিত, এমন পরামর্শও দিলেন কেউ কেউ। স্টেট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের শিক্ষার্থী আখতারুজ্জামান বলছিলেন, ‘শুরুর দিকে আমরা বেশির ভাগ বাইকারের মাথায়ই হেলমেট দেখতে পাইনি। টানা কয়েক দিন মানুষকে বলতে বলতে এই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন রাস্তায় প্রায় ৮০ শতাংশ বাইকারই হেলমেট ব্যবহার করছেন।’ ১৫ আগস্ট এই শিক্ষার্থীর সঙ্গে যখন কথা হয়, তখনো তিনি ধানমন্ডিতে দায়িত্ব পালন করছিলেন।
৩. লেন মেনে চলা
গত কয়েক দিনে বড় গাড়ি ও ছোট গাড়িগুলোকে আলাদা লেনে রাখার চেষ্টা ছিল শিক্ষার্থীদের মধ্যে। বিশেষ করে বাঁ পাশের লেনটা যেন খালি রাখা যায়, সেদিকে জোর দিয়েছেন অনেকে। শিক্ষার্থীরা বলছেন, এতে যেমন গাড়ির জট কমে, তেমনি জরুরি কার্যক্রমে নিয়োজিত, যেমন অ্যাম্বুলেন্স বা ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলোকেও এগিয়ে দেওয়া যায়। তিতুমীর কলেজের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র দেলোয়ার হোসেন দায়িত্ব পালন করেছেন রামপুরা ব্রিজ এলাকায়। বলছিলেন, ‘বাইকচালক, রিকশাচালকেরা বারবার লেন পরিবর্তন করতে চান। বাসচালকদের মধ্যেও ওভারটেক করার প্রবণতা প্রবল। এটাও যানজটের অন্যতম কারণ। আমরা অনেকজন ছিলাম, সে জন্য হয়তো লেন নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছি। কিন্তু দু–তিনজন ট্রাফিক পুলিশের পক্ষে তো এটা সম্ভব নয়। সে জন্য সাধারণ মানুষকেই দায়িত্ব নিতে হবে। সবাই যদি নিয়ম মেনে চলে, তাহলে কিন্তু আর ট্রাফিক পুলিশেরই দরকার হয় না।’
তবে ভিন্নমতও দিলেন কেউ কেউ। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হামজা বিন মোহসিন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের কাজ করেছেন খিলগাঁও রেলগেট এলাকায়। তিনি বলেন, ‘আমাদের শহরটা তো আসলে পরিকল্পিতভাবে গড়া নয়। গাড়ির চাপ অনেক। এত কড়াকড়িভাবে লেন নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে দেখেছি, কখনো কখনো যানজট আরও বেড়ে গিয়েছে।’ রামপুরা ব্রিজ এলাকায় কাজ করেছেন ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্র তারিকুল ইসলাম। তিনিও কথা বললেন একই সুরে।
৪. ফিটনেস জরুরি
ফিটনেসবিহীন গাড়িকেও বড় সমস্যা মনে করছেন শিক্ষার্থীরা। তাঁরা বলছেন, আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা গেলে এই সমস্যা রোধ করা সম্ভব। স্টেট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের ছাত্র আখতারুজ্জামান বলছিলেন, ‘লোকাল বাসগুলোর বেশির ভাগেরই ফিটনেস নেই। আবার গত কয়েক দিন যেমন রাস্তায় প্রচুর অটোরিকশা চলেছে। অটোরিকশাগুলোর ব্রেকের অবস্থা একেবারেই ভালো না। যত দ্রুত চলে, সেই তুলনায় ব্রেক খুবই দুর্বল।’
শিক্ষার্থীরা বলছেন, কাগজপত্র ঠিক না থাকলে চালকদের মধ্যে একধরনের বেপরোয়া ভাব দেখা যায়। ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের ছাত্র ফেরদৌস আহমেদের বক্তব্য, ‘ট্রাফিক পুলিশের প্রতি শ্রদ্ধা ফিরিয়ে আনা দরকার। তাঁদের কাজে যদি সততা ও পরিবর্তনের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখা যায়, তাহলে চালকেরাও নিশ্চয় আরও সচেতন হবেন।’
৫. গাড়ি থামার নির্দিষ্ট জায়গা
ইন্টারন্যাশনাল নার্সিং কলেজের শিক্ষার্থী সাদিয়া ইসলাম কাজ করেছেন উত্তরার হাউস বিল্ডিং এলাকায়। তিনি মনে করেন, বাসগুলো যেখানে-সেখানে থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করে বলে যানজট আরও বেড়ে যায়। এ প্রবণতার কারণে লেন ঠিক রাখা কঠিন হয়ে যায় আরও। শুধু বাস নয়; রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা ভাড়ায় চালিত বাইকগুলোর জন্যও নির্দিষ্ট জায়গা থাকা উচিত বলে মনে করেন শিক্ষার্থীরা।