কীভাবে হবেন নিজের সেরা ভার্সন?
প্রত্যেক মানুষেরই নিজস্ব সত্তা থাকে, ব্যক্তিত্ব থাকে। কেউ খুব সহজে ভিড়ের ভেতর মিশে যেতে পারেন। কারও অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলতেই অস্বস্তি হয়। যে চাকরির সাক্ষাৎকারে গিয়ে কারও হাত কাঁপে, সেখানেই হয়তো আরেকজন বাজিমাত করে ফেলে। নিজের সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস কম থাকা কিংবা যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস থাকার পরও সময়মতো তা তুলে ধরতে না পারার সমস্যাতেও অনেকে ভোগেন। এসব সমস্যার সমাধান দিতে পারে ইমেজ ডেভেলপমেন্ট বা ভাবমূর্তি উন্নয়ন প্রশিক্ষণ।
ভাবমূর্তি উন্নয়ন পশ্চিমা বিশ্বে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বড় বড় তারকা বা করপোরেট ব্যক্তিদের পেশাদার ম্যানেজাররা মূলত তাঁদের ইমেজ ডেভেলপমেন্টের কাজই করেন। ভারতে বলিউড তারকাদেরও ম্যানেজার থাকেন, যাঁরা মূলত তাঁদের ‘পাবলিক ইমেজ’ নিয়েই কাজ করেন। অনেক সময় দেখা যায় যে ব্যক্তির ব্যক্তিগত বা পারিবারিক ইমেজে থেকে ‘পাবলিক ইমেজ’ সম্পূর্ণ ভিন্ন। কোনো তারকার ইমেজ কোনো কারণে বিঘ্নিত হলে ইমেজ পুনরুদ্ধার নিয়েও কাজ করেন পেশাদারেরা। অনেক সময় একজন ব্যক্তির ভাবমূর্তি উন্নয়নে একাধিক পেশাদার বা একটা দল কাজ করে। যাঁরা এসব তারকা বা বিভিন্ন পদে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের পাবলিক ইমেজ নিয়ে কাজ করেন, তাঁদের বেতন কোটি টাকাও হয়।
বিষয়টি আমাদের দেশে এখনো বেশ নতুন। গেল জুলাইয়ে সিলেটের পদ্মশ্রীদের সঙ্গে তাঁর কাজ ও লেখাপড়া নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে ইমেজ ডেভেলপমেন্ট সম্পর্কে জানতে পারি। ভারতের বেঙ্গালুরুতে উচ্চশিক্ষা নেওয়ার পাশাপাশি ভাবমূর্তি উন্নয়ন বিষয়ে শিখছেন পদ্মশ্রী। ভারতের বেশ কয়েকটি ইনস্টিটিউট এ বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়। ইমেজ কনসাল্টিং বা ইমেজ ম্যানেজমেন্ট নামেও একই ধরনের কোর্স করানো হয়। বাংলাদেশে কোনো প্রতিষ্ঠান সরাসরি এই কোর্স করায় না। দু–একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পেশাজীবীদের জন্য ইমেজ ডেভেলপমেন্ট কোর্স থাকলেও তার ব্যাপ্তি খুব বেশি নয়।
ভাবমূর্তি উন্নয়ন এমন একটি পদ্ধতি, যার মাধ্যমে একজন মানুষের ভেতর থেকে তাঁর সেরাটুকু বের করে আনা হয়। অর্থাৎ ‘ইমেজ ডেভেলপমেন্ট’ প্রশিক্ষকের কাজ হলো একজন বা একদল মানুষের ভেতর থেকে তাঁর সবচেয়ে ভালো বিষয়গুলো বের করে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া, তাঁর ব্যক্তিগত বা পেশাজীবনকে সহজ বা সুন্দর করতে সাহায্য করা। কীভাবে একজন মানুষ অন্যদের সামনে নিজেকে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উপস্থাপন করবেন, কীভাবে তাঁর ব্যক্তিত্বের গঠন সুন্দর হবে, কোন উপায়ে তিনি নিজের পেশা ও ব্যক্তিজীবনের মধ্যে সমন্বয় করবেন, তার সবই শেখানো হয় এই প্রশিক্ষণে।
ইমেজ ডেভেলপমেন্ট এমন একটি বিষয়, যেখানে একজন মানুষের জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় সবকিছু শেখানো হয়। নিজেকে আরও উন্নত করা, সুন্দরভাবে কথা বলা, দক্ষতার সঙ্গে সমস্যার সমাধান করা, মানুষের সঙ্গে মেশা, ভালো প্রেজেন্টেশন দেওয়া, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে চলা, যোগাযোগ দক্ষতা—সব শেখানো হয়। মোটকথা, ভাবমূর্তি উন্নয়ন আপনাকে আপনার সবচেয়ে ভালো সংস্করণটি হয়ে উঠতে সাহায্য করবে।
ইমেজ ডেভেলপমেন্ট কেন জরুরি, জানতে চাইলে পদ্মশ্রী বলেন, এই প্রশিক্ষণ নিলে একজন মানুষ তাঁর চলাফেরা, কথাবার্তা, আচার-আচরণ—সবকিছু নিয়ে অনেক আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। আমরা যে যুগে বাস করি, সেখানে নিজেকে সঠিকভাবে উপস্থাপন করা খুবই জরুরি। এমনকি কেউ আমার সম্পর্কে কী ভাবছে, সেটা নিয়েও অনেক সময় আমরা হীনম্মন্যতায় ভুগি। ভাবমূর্তি উন্নয়ন সেই জায়গায় কাজ করে। প্রত্যেক মানুষ যেন নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসী হন, পেশাজীবন অনুযায়ী নিজে গড়ে তুলতে পারেন, সহকর্মীদের সঙ্গে, পরিচিতদের সঙ্গে সঠিক আচরণ করতে পারেন, সেই আত্মবিশ্বাসই তাঁকে দেওয়া হয়। বিষয়টি শিখলে নেতৃত্বের দক্ষতা বাড়ে, যোগাযোগ–দক্ষতা উন্নত হয়, পোশাক-আচরণ সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায়।
যেহেতু বিষয়টির সঙ্গে পেশাজীবনের সরাসরি যোগসূত্র আছে, তাই আরও জানতে পাশা গ্রুপের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান ফারহানা রহমানের সঙ্গে কথা বলি। তিনি জানালেন, ঠিক ইমেজ ডেভেলপমেন্ট বলে কোনো কিছু এখন বাংলাদেশের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় পড়ানো হয় না। তবে বিজনেস কমিউনিকেশন কোর্সের আওতায় এ–সম্পর্কিত কিছু বিষয় পড়ানো হয়। যেখানে নিজের ব্যক্তিত্ব তৈরি, আই কনট্যাক্ট, আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলা ইত্যাদি শেখানো হয়।
ফারহানা বললেন, ‘ধরুন, আপনি কোথাও চাকরির জন্য সাক্ষাৎকার দিতে গেলেন। তখন বোর্ডের সদস্যরা শুরুতেই দেখবেন আপনার দেহভঙ্গি, প্রাথমিক আচরণ। কথা বলতে গিয়ে আপনার হাত-পা কাঁপছে কি না, আপনি সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে, হাসিমুখে কথা বলতে পারছেন কি না ইত্যাদি। জীবনবৃত্তান্ত দেখে প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের জন্য ডাকা হয়। কিন্তু তিনি কীভাবে কথা বলছেন, কেমন পোশাকে এসেছেন, কাজের বিষয়ে তাঁর আত্মবিশ্বাস কতটুকু, তিনি কেমন ধরনের মানুষ—এসব দেখা হয় সাক্ষাৎকারের সময়। কাজেই নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকা জরুরি।’ সাধারণত মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা বিষয়ে এমবিএ করতে গেলে এসব বিষয়ে পড়ানো হয় বলেও জানান তিনি।
তবে পদ্মশ্রীর প্রতিষ্ঠান ‘ট্রিপল-এ’তে ভাবমূর্তি উন্নয়নের আলাদা কোর্স রয়েছে। শিশুদের জন্যও রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। মানুষের ভেতর-বাহির দুদিকের উন্নতির কথা মাথায় রেখেই তাঁর ইমেজ ডেভেলপমেন্ট কোর্স সাজিয়েছেন যোগব্যায়ামের প্রশিক্ষক পদ্মশ্রী। যোগব্যায়াম, লাইফ গ্রুমিং, রাগ নিয়ন্ত্রণ, সময় ব্যবস্থাপনা, নেতৃত্ব, কর্মক্ষেত্রে নীতিগত সততা, দলগতভাবে কাজ করার মানসিকতা, কর্মক্ষেত্রে সহকর্মীর সঙ্গে ব্যবহার, অনেক মানুষের মধ্যে কথা বলার ধরন ইত্যাদি শেখানো হয় এসব কোর্সে। এ ছাড়া শিশুদের জন্য বিশেষায়িত কোর্সটিতে শেখানো হয় শ্রেণিকক্ষের সাধারণ ভদ্রতা, খাবার টেবিলের আচরণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মুঠোফোনে আসক্তি থেকে দূরে থাকার কৌশল, নীতিগত উন্নয়ন ইত্যাদি।