আমাদের দোষটা কোথায়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক কৌশল বিভাগ থেকে পাস করার পর আমার মাথায়ও বিদেশে পড়ার পোকা ঢুকেছিল। রেজাল্ট ভালো থাকায় মা-বাবাও উৎসাহ জোগালেন। তবে শর্ত ছিল, পড়াশোনা শেষ করে দেশে ফিরতে হবে।
ইউরোপের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করা শুরু করি। একপর্যায়ে দুটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে পড়ার সুযোগও পেয়ে যাই—স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব গ্লাসগো ও নেদারল্যান্ডসের মাসট্রিক্ট বিশ্ববিদ্যালয়।
তবে বৃত্তি না পেলে এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার আশার গুড়ে বালি। অতএব হন্যে হয়ে এবার বৃত্তির সুযোগ খুঁজতে শুরু করি।
পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কিছু আংশিক ফি মওকুফের সুযোগ থাকলেও মাস্টার্সের জন্য সম্পূর্ণ টিউশন ফি, সঙ্গে থাকার খরচ দেওয়ার মতো বৃত্তি এখন ইউরোপে কমই আছে। তবে ছোট-বড় সব দেশেই বিপাকে পড়া শিক্ষার্থীদের জন্য সরকারিভাবে কিছু সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা থাকে। আমাদের দেশে এ রকম দুটি সুবিধা ‘প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ’ ও ‘বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ’। সরকারি এই দুটি ফেলোশিপের আওতায় সম্পূর্ণ টিউশন ফি, মাসিক উপবৃত্তি এবং দেশ থেকে যাওয়া-আসার ফ্লাইট খরচ দেওয়া হয়।
খোঁজ নিয়ে জানলাম, এখানে আবেদন করার জন্য শুরুতেই কিছু বিষয় মিলিয়ে নিতে হয়। বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপের মাধ্যমে মাস্টার্সের বৃত্তির জন্য আবেদন করতে ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’ র্যাঙ্কিংয়ে ৩০০–এর মধ্যে থাকা কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশিপের ক্ষেত্রে র্যাঙ্কিং প্রয়োজন ১৫০–এর মধ্যে। এর আগে বিদেশে কোনো মাস্টার্সের ডিগ্রি থাকা চলবে না, পড়ালেখা শেষে দেশে ফিরতে হবে, এমন আরও কিছু শর্ত আছে। আমি যে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেয়েছি, দুটিই ‘টাইমস হায়ার এডুকেশন’-এর র্যাঙ্কিং অনুযায়ী শীর্ষ ১৫০–এর মধ্যে আছে। খোঁজখবর নিয়ে বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপে আবেদনের প্রস্তুতি নিই।
যেদিন ফেলোশিপ আবেদনের সময়সীমা শেষ, ঠিক সেদিন ২০২৪ সালের ১৫ মে একগাদা কাগজপত্র জমা দিয়ে আসি ফেলোশিপের অফিসে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের অফার লেটার, চাকরির সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি, শিক্ষাজীবনের সব ধরনের সনদপত্র, কাগজপত্রের মধ্যে রীতিমতো হাবুডুবু খেতে হচ্ছিল। ফলাফলের অপেক্ষা করতে করতে আরও কিছু বৃত্তির জন্য আবেদন করে ফেলি।
৩০ জুন ফেলোশিপের রেজাল্ট প্রকাশিত হয়। কাঁপা কাঁপা হাতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ফেলোদের তালিকার লিংকে ক্লিক করি। লিস্টের প্রথম দুজন ছিলেন অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে মেডিকেল সায়েন্স নিয়ে পড়ার জন্য নির্বাচিত। তারপর দেখি আরও দুজনের নাম। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনে একজন জনস্বাস্থ্য, অন্যজন নগর পরিকল্পনা নিয়ে পড়তে যাচ্ছেন। দেখে আশা হারিয়ে ফেলি। মনে হয় না এত মেধাবীর তালিকায় কোথাও আমার নামটা খুঁজে পাব। তবে ধারণা ভুল প্রমাণিত হয় তালিকার ২১ নম্বর পর্যন্ত যেতে যেতে। সেখানে মাসট্রিক্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে পড়ার জন্য নিজের নামটাও দেখতে পাই।
এবার আরও অনেক কাগজপত্র জমা দেওয়ার পালা। দাপ্তরিক স্ট্যাম্প পেপারে ২ বছরের ডিগ্রি শেষে দেশে ফেরত আসার অঙ্গীকারনামা জমা দিই। অঙ্গীকারনামার সঙ্গে ২ জন সাক্ষীর অঙ্গীকারনামাও থাকা লাগে, যাঁদের মধ্যে একজনকে হতে হবে সরকারি কর্মকর্তা। জমা দিতে হয় সরকারি হাসপাতাল থেকে প্রদত্ত মেডিকেল ফিটনেস সনদ। তা ছাড়া প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার সত্যায়িত বেশ কিছু কাগজও জমা দিতে হলো। দ্বিতীয় ধাপে কাগজ জমা দেওয়ার পরপরই আমার নামে জারি হওয়া সরকারি আদেশ এবং ভিসা আবেদনের জন্য স্পনসরশিপ চিঠিও পেয়ে যাই।
১৫ জুলাইয়ের পর থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে সরব হই। তবে ভেতরে-ভেতরে ভয়ও কাজ করে—না জানি এই ‘অপরাধে’ আমার ফেলোশিপটা বাতিল হয়ে যায়। অনলাইন জগতে প্রতিবাদ করার কারণে তখন বাঘা বাঘা অনেককেও কড়া মাশুল দিতে হচ্ছিল। মনে আছে, ফেলোশিপ অফিসে বসে অজানা আতঙ্ক কাজ করছিল স্রেফ একটা প্রোফাইল ছবি বদলানো নিয়ে। হয়তো এখনই কেউ এসে বলবে, ‘এই যে মেয়ে—তুমি। তুমি বের হয়ে যাও! এই সুযোগ-সুবিধা প্রতিবাদীদের জন্য না।’
৫ আগস্ট সরকার পতনের রোমাঞ্চে ভুলেই গিয়েছিলাম নিজের ভবিষ্যতের কথা। ২১ আগস্ট প্রথম ফেসবুকে দেখতে পাই কোনো রকম পুনর্মূল্যায়নের আশ্বাস ছাড়াই প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। যাঁদের ফেলোশিপ বাতিল হয়েছে, তাঁদের অনেকে নিজ খরচে ইতিমধ্যে বিদেশ চলেও গিয়েছিলেন। তাঁদের পড়াশোনার খরচ, বিমানের খরচ—ইত্যাদি সরকার থেকে শোধ করে দেওয়া হবে, সেই আশায়। বিদেশে বসেই তাঁরা জানতে পারেন, তাঁদের ফান্ডিং আর নেই।
প্রধানমন্ত্রী ফেলোশিপ বাতিল হওয়াটা একটা পূর্বাভাসই দেয়—বঙ্গবন্ধু ফেলোশিপ বাতিল হতে বেশি দিন বাকি নেই। পাগল হয়ে ছুটি ফেলোশিপ অফিসে। সেখানে আমাদের জানানো হয়, তাঁরা নিরপেক্ষভাবেই শিক্ষার্থী নির্বাচন করেছেন। অফিস থেকে আরও জানানো হয়, খুব শিগগিরই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁদের বৈঠক হবে, যেখানে ফেলোশিপের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করা হবে। শুনে মনে কিছুটা আশা জাগে, হয়তো নির্বিচারে ফেলোশিপটি বাতিল করা হবে না। অপেক্ষা না করে এই সময়ে বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে ই-মেইল আদান প্রদান শুরু করি। আগস্টের মাঝামাঝি ২০২৪ সালে পড়াশোনার জন্য বৃত্তির আবেদনের সুযোগ সব জায়গায়ই মোটামুটি বন্ধ হয়ে যায়। এই পর্যায়ে বুঝতে পারি, ফেলোশিপ বাতিল হলে আরও এক বছর অপেক্ষা করা ছাড়া আমার কোনো উপায় থাকবে না।
সরকার পতনের এক মাস পরও ফেলোশিপ বাতিলের কোনো খবর আসে না। ফেলোশিপ অফিসে যোগাযোগ করলে দৃঢ়তার সঙ্গেই আমাদের জানানো হয়—নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিরপেক্ষ ছিল। এর মধ্যে ফেলোদের পক্ষ থেকে নির্বাচনপ্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে সন্দেহ থাকলে সম্পূর্ণ পুনর্মূল্যায়ন করার জন্য আবেদন করা হয়। নতুন করে পাওয়া বাংলাদেশে স্বচ্ছতার জায়গা থাকা উচিত। যদি অনিরপেক্ষ প্রক্রিয়ায় ফেলোশিপ দেওয়ার অভিযোগ থেকেই থাকে, তবে অবশ্যই অন্য আবেদনকারীদের ন্যায্য সুযোগ দেওয়ার জন্য পুনর্মূল্যায়ন করা উচিত।
সরকার পতনের ঠিক ৩৭ দিন পর ওয়েবসাইটে ছোট্ট একটা প্রজ্ঞাপন জারি হলো। সেই প্রজ্ঞাপনের সারমর্ম—‘৩০ জুনের প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হলো।’ সঙ্গে দেখলাম ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ফেলোশিপ আদেশ, ফলাফলের প্রজ্ঞাপন, এমনকি আবেদন আহ্বানের প্রজ্ঞাপনও ওয়েবসাইট থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। ওয়েবসাইট দেখে বোঝাই যাবে না, এই বছর কোনো ধরনের ফেলো নির্বাচনের প্রক্রিয়া হয়েছে।
ফেলোশিপ বাতিল হওয়ার পরও বেশ কয়েকবার ওয়েবসাইটে গিয়েছি ঠুনকো আশা নিয়ে। সেখানে দেখলাম, ফেলোশিপ কমিটির কর্মকর্তা বদলায়নি। বদলেছে শুধু নোটিশ বোর্ড। সেখানে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ফলাফল বাতিল হওয়া ছাড়া এই বছরের ফেলোশিপবিষয়ক কোনো তথ্য নেই।