সন্তানকে অনলাইনে কতটুকু উপস্থাপন করবেন
নিলয়ের ( ছদ্মনাম ) বয়স সবে ১২। মায়ের সঙ্গে সারাক্ষণ খুনসুটিতে মেতে থাকে। ছেলের সঙ্গে এই খুনসুটি মুঠোফোনে ধারণ করে ফেসবুকে রিল আকারে পোস্ট করতেন মা। অল্প দিনেই দর্শকের সংখ্যা হু হু করে বেড়ে যায়। পরে ইউটিউবে নিজেদের যৌথ চ্যানেলও খোলেন। সেখানেও অনুসারীর সংখ্যা লাখ পেরিয়েছে ছয় মাস আগে। পেয়েছেন ইউটিউবের বাটনও। খুলে গেছে আয়ের পথ। আর তারকাখ্যাতি তো আছেই। স্বজনদের কাছে এই মা-ছেলে এখন তারকা।
কিন্তু ১০ বছর বয়সী তরী (ছদ্মনাম) এবং তার মা–বাবা শিমু ও পল্লবের ক্ষেত্রে উল্টোটা ঘটেছে। বিষয়টি উপভোগের পরিবর্তে তাঁদের জীবনে অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। নানা বিষয় নিয়ে ভ্লগিং করে তরী। ভ্লগিং রীতিমতো তার নেশায় পরিণত হয়েছে। ইউটিউবে তার চ্যানেলে অনুসারীর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। তারকাখ্যাতিও এসেছে। এই খ্যাতি নিয়ে উচ্ছ্বসিত মা–বাবাও। মা-বাবা প্রায় সব সময় আইডিয়া দিয়ে উৎসাহ দেন তরীকে। তার ভিডিও কনটেন্ট মা-বাবা মা শেয়ার করেন ফেসবুকে।
ফেসবুকের বিভিন্ন পেজের অ্যাডমিন তরীর সাক্ষাৎকার নিয়ে নিজেদের পেজে শেয়ার করেন। সেখানে ব্যবহারকারীদের হাজারো মন্তব্য আসতে থাকে। অনেক ভালো, উৎসাহমূলক মন্তব্যের পাশাপাশি নেতিবাচক মন্তব্যও আসে। আসে অশালীন মন্তব্যও। এসব দেখে তারকাখ্যাতি পাওয়া তরীর ভীষণ মন খারাপ হয়। অতটুকু বয়সেই সে বিষণ্ন হয়ে পড়ে। আগ্রহ হারিয়ে ফেলে পড়াশোনা, ভ্লগিংসহ সবকিছুতে। খেলতে চায় না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অধিক সক্রিয় তরী পরিবারের সদস্যদের সঙ্গেও অন্যমনস্ক হয়ে কথা বলে। সহপাঠীসহ সবার কাছ থেকে দূরে দূরে থাকার চেষ্টা করে। এসব নিয়ে তার মা-বাবাও অস্বস্তিতে পড়েছেন।
তরীর মা শিমু বলেন, ‘ছোট্ট মেয়েটা এত বিষণ্ন হয়ে থাকে, মেনে নিতে পারছি না। এখন মনে হয়, ওকে অনলাইনে উপস্থাপন করাটাই আমাদের ঠিক হয়নি। অনলাইনে না এলে, তারকাখ্যাতি না পেলে হয়তো এমন হতো না। সবকিছু স্বাভাবিক হতো। বিষয়টা এখন জটিল হয়ে উঠছে। কেন যে এমন হলো!’
এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গেছে জাপানের কিয়োটো ইউনিভার্সিটির দুই গবেষক রিকুয়া হাসোকাওয়া ও তোশিকি কাতসুরার কাছে। তাঁরা বলেন, যদি মা-বাবা তত্ত্বাবধান বা নিয়ন্ত্রণ না করেন, তাহলে স্মার্টফোন ও ট্যাবলেটের ব্যবহার শিশুর বিকাশের ক্ষতি করতে পারে। এমন শিশুদের হাইপারঅ্যাকটিভ ও অমনোযোগী হওয়ার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।
রিকুয়া হাসোকাওয়া ও তোশিকি কাতসুরা এ বিষয় নিয়ে ‘অ্যাসোসিয়েশন বিটুইন মোবাইল টেকনোলজি ইউজ অ্যান্ড চাইল্ড অ্যাডজাস্টমেন্ট ইন আরলি এলিমেন্টারি স্কুল এজ’ শিরোনামে একটি গবেষণা করেছেন। গবেষণা প্রতিবেদনটি যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল লাইব্রেরি অব মেডিসিন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
এই দুই গবেষক বলেন, ইন্টারনেট একটি বিশাল জায়গা। এর অন্ধকার দিকও অনেক। পর্নোগ্রাফি, অশালীন ভাষার মতো বিষয়গুলো শিশুদের বিভ্রান্ত করতে পারে। এ ছাড়া অনলাইন চ্যাট বা মন্তব্য করার ক্ষেত্রে শিশুরা অন্যের মানসিক চাহিদা ঠিকভাবে বুঝতে পারে না। এতে শিশুর শারীরিক যোগাযোগ ও ব্যক্তিগত মিথস্ক্রিয়া হ্রাস পায়। যা শিশুর সামাজিক ও মানসিক বিকাশকে বাধা দেয় বা অস্বাভাবিক বিকাশ ঘটায়। আবার অনলাইনে সহিংস গেম খেলে শিশু সহিংসও হয়ে উঠতে পারে। অনেক সময় অসহিষ্ণু, অসামাজিক ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে শিশু।
তাহলে কি শিশুদের অনলাইন থেকে একদম দূরে রাখতে হবে? আর এ যুগে কি তা সম্ভব? জবাব পাওয়া গেছে ব্রিটিশ মনোবিজ্ঞানী মার্ক ডি. গ্রিফিথসের কাছে। তিনি ‘ফ্রেন্ডশিপ অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট ইন চিলড্রেন অ্যান্ড অ্যাডলোসেন্টস: দ্য ইমপ্যাক্ট অব ইলেকট্রনিক টেকনোলজি’ শীর্ষক গবেষণায় বলেন, শিশুর বিকাশে ইন্টারনেটের প্রভাব ইতিবাচক বা নেতিবাচক হতে পারে। তবে তা নির্ভর করে ব্যবহারের ওপর। এ ক্ষেত্রে সন্তানের অনলাইন ব্যবহারের পুরো বিষয়ের ওপর সচেতনভাবে মা-বাবাকে নজরদারি করতে হবে। অনলাইনে কী করা যাবে আর কী করা যাবে না, তার সীমারেখা নির্দিষ্ট করে দিতে হবে। কারণ, অনলাইনের অতিরিক্ত ব্যবহার শিশুদের সামাজিক বিচ্ছিন্নতা বৃদ্ধি করে।
বয়সভেদে শিশুকে অনলাইনে যেভাবে উপস্থাপন
বয়সভেদে শিশুকে অনলাইনে যেভাবে উপস্থাপন করা হবে, তার ক্যাটাগরি করেছে দ্য আমেরিকান অ্যাকাডেমি অব পেডিয়াট্রিকস। মোট তিনটি ক্যাটাগরিতে শিশুদের ভাগ করা হয়েছে। এগুলো হলো—দুই বছর বয়সের নিচের শিশু, দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশু ও স্কুলপড়ুয়া শিশু।
গবেষকেরা বলেন, দুই বছরের নিচের শিশুকে যদি কোনো ডিভাইস হাতে দিতেই হয়, তাহলে কেবল শিশুদের জন্য উচ্চ রেজল্যুশনের ভিডিও ও শিক্ষণীয় অ্যাপ দেখতে দিতে হবে। তবে কিছুতেই তাদের একা হাতে কোনো ডিভাইস ব্যবহারের জন্য দেওয়া যাবে না।
দুই থেকে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের দিনে কেবল এক ঘণ্টার জন্য ডিভাইস ব্যবহার করতে দেওয়া যেতে পারে। অনলাইনে কোনো কাজ করার ক্ষেত্রে মা-বাবা সামনেই থাকবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিশুকে নিয়ে কোনো পোস্ট দিলে তার মন্তব্য নিয়ে মা–বাবা সন্তানের সঙ্গে আলোচনা করবেন। সহিংস কোনো ভিডিও বা গেম খেলতে দেওয়া যাবে না।
স্কুলপড়ুয়া শিশুদের ক্ষেত্রে অনলাইন ব্যবহারের নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করে দিতে হবে। মুঠোফোন, কম্পিউটার বা ট্যাবলেটে ইন্টারনেট ব্যবহারের একটি নিয়ম করে দিতে হবে। শিশুকে এটাও বোঝাতে হবে যে কেন এই নিয়ম মেনে চলা জরুরি। যদি শিশুদের স্কুলের কার্যক্রমের জন্য বাসায় ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রয়োজন হয়, তাহলে সেটাও মা–বাবার নজরদারিতে রাখতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শিশুদের জন্য ইন্টারনেট ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জরুরি। এ ক্ষেত্রে শিশুর হাতে যে যন্ত্র দেওয়া হবে, তাতে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল ই-মেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করতে হবে। ইউটিউব কিডস, প্যারেন্টাল সেফ ব্রাউজার, বিভিন্ন অ্যাপ বা ওয়েবসাইটের চাইল্ড ভার্সন অপশন চালু রাখতে হবে। আবার কিছু কিছু সাইট ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারের সঙ্গে যোগাযোগ করে ব্লক করে দেওয়া যায়। তাই খেয়াল রাখতে হবে, সন্তান কোন সাইটের দিকে বেশি আকৃষ্ট হচ্ছে। যদি সেটা খারাপ কোনো সাইট হয়, তাহলে ব্লক করে দেওয়াই ভালো। শিশুরা অনলাইনে যেটুকু সময় কাটাবে, মা–বাবাকেও তাদের সঙ্গে ওই কাজে অংশ নিতে হবে। মা-বাবা অনলাইনে নিজেরা কী করছেন, কী দেখছেন, সে বিষয়েও সচেতন হতে হবে। তাহলেই শিশুদের অনলাইনে নিরাপদ রাখা যাবে।