ঘোড়ায় চড়া শেখাতে ঢাকায় ট্রেনিং সেন্টার চালু করেছেন জাহেদুল
বিদেশে প্রশিক্ষণ নিয়ে রপ্ত করেছেন খ্যাপাটে ঘোড়াকে বশে আনার কৌশল। শিখেছেন ঘোড়াকে নিয়ন্ত্রণে এনে ইচ্ছেমতো পরিচালনা করার নিয়ম। এভাবে শখের ঘোড়সওয়ার থেকে রীতিমতো পেশাদার প্রশিক্ষক হয়ে উঠেছেন জাহেদুল ইসলাম, দিয়েছেন প্রশিক্ষণকেন্দ্র। জাহেদুলের গল্প শুনলেন সজীব মিয়া
ঘোড়ায় চেপে বসেছেন এক তরুণী। তাঁর হাতে লাগাম ধরিয়ে দিয়ে ইশারায় কী যেন নির্দেশনা দিলেন জাহেদুল ইসলাম। তা মেনে তরুণী লাগামে হ্যাঁচকা টান দিতেই ঘোড়াটা টগবগ টগবগ করে এগোতে শুরু করল।
বিস্তৃত মাঠের মধ্যে একখণ্ড জমি, চারপাশ বাঁশ দিয়ে ঘেরা। পাশেই আমগাছের ছায়ায় কয়েকটি চেয়ার পাতা, সেখানে জাহেদুলের অপেক্ষায় বসে আছি আমরা। একটু আগেই অনুশীলন শেষ করে পাশের একটা চেয়ারে এসে বসেছেন আরেক প্রশিক্ষণার্থী। মাথা থেকে কাউবয় হ্যাট হাতে নিতে নিতে জানালেন, আতিক আনন্দ কর তাঁর নাম। ঘোড়ায় চড়ার ইচ্ছা অনেক দিনের। ভেবেছিলেন কখনো দেশের বাইরে গেলে চালানো শিখবেন। ভাগ্যক্রমে দেশেই পেয়ে গেছেন শেখার সুযোগ। বন্ধুর মাধ্যমে খোঁজ পেয়ে ভর্তি হয়েছেন। দ্বিতীয় দিনের মতো ঘোড়ায় চড়ে ভীষণ রোমাঞ্চিত তিনি।
আতিকের সঙ্গে গল্প করতে করতেই পাশের চেয়ারে এসে বসলেন জাহেদুল। মাথায় কাউবয় হ্যাট, পায়ে বুট, হাতে চাবুক—আপাদমস্তক অশ্বারোহী। ছোটখাটো গড়নের মানুষ। ২০২২ সালে এই ‘হর্স রাইডিং ট্রেনিং সেন্টার’ শুরু করেছেন। কুড়িল-পূর্বাচলের ৩০০ ফুট রাস্তা থেকে নেমে পূর্বাচল ক্লাব পেরিয়ে মিনিট দুয়েক গেলেই এই সেন্টার। ট্রেনিং সেন্টার বলতে যে ধরনের অবকাঠামো চোখে ভাসে, তার কিছুই এখানে নেই। সপ্তাহের শুক্র ও শনিবার সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কয়েক পর্বে ২০ জনকে প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এই দুটি দিন চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে থাকেন জাহেদুল ইসলাম।
কিন্তু কে এই জাহেদুল ইসলাম, ঘোড়সওয়ারি প্রশিক্ষকই-বা হলেন কী করে?
বাসায় তুমি থাকবে, না হয় ঘোড়া থাকবে
টিভি পর্দায় দেখতেন দুর্বার গতিতে ছুটে চলেছে ঘোড়া। হলিউডের বিভিন্ন সিনেমায় দেখতেন ঘোড়া নিয়ে ছুটছে নায়ক। কল্পনায় নিজেকেও ঘোড়ার পিঠে আবিষ্কার করতেন স্কুলপড়ুয়া জাহেদুল। সেই রোমাঞ্চ তাঁকে মনেই পুষে রাখতে হয়েছে এসএসসি পর্যন্ত। তবে এর মধ্যে চট্টগ্রামে বাড়ির কাছের পতেঙ্গা সৈকতে গিয়ে ঘোড়ায় চড়েছেন। পাশের এলাকায় যে মানুষটা ঘোড়া পুষতেন, তার সঙ্গেও গড়ে তুলেছেন সখ্য। কিন্তু নিজের একটা ঘোড়া হবে সেই স্বপ্ন দেখেছেন আরও পরে।
এসএসসি রেজাল্টের আগে তিন মাস অবসর। ‘ঘোড়ারোগ’টা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। ব্যাংকার বাবার কাছে গিয়ে একটা ঘোড়া কিনে দেওয়ার আবদার করলেন। শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন বাবা, সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘বাড়িতে হয় তুমি থাকবে, না হয় ঘোড়া থাকবে!’
কিন্তু জাহেদুল যে ঘোড়া নিয়েই বাড়িতে থাকতে চান! তাই মাকে গিয়ে ধরলেন এবার। নাছোড় ছেলেকে ফেরাতে পারলেন না মা। ছেলের বাবাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে ঘোড়া কিনে দিতে রাজি করালেন। কোথায় ঘোড়া কিনতে পাওয়া যায়, খোঁজখবর শুরু করলেন জাহেদুল।
পরিচিত এক ঘোড়াপালকের মাধ্যমে বিক্রেতার সন্ধানও পাওয়া গেল। চট্টগ্রামের সাগরিকা এলাকায় থাকেন ভদ্রলোক। নিজের ঘোড়াটাই বিক্রি করে দেবেন। দাম হাঁকালেন দেড় লাখ টাকা। শেষে এক লাখ বিশে রফা হলো।
ঘোড়া নিয়ে বাসায় ফিরলেন জাহেদুল। কিন্তু ঘোড়া রাখবেন কোথায়? ঘোড়া রাখার কোনো ঘর তো তাঁদের নেই। ঘর তুলতে হলো। খাওয়াদাওয়া, পরিচর্যার জন্যও সার্বক্ষণিক একজনকে রাখতে হলো, সঙ্গে থাকলেন জাহেদুল।
দেশে দেশে প্রশিক্ষণ
পড়াশোনা আর ঘোড়া—এই নিয়ে কাটতে থাকল জাহেদুলের সময়। ঘোড়ার কল্যাণে বন্ধুদের কাছেও হয়ে উঠলেন বিশেষ সমীহের পাত্র। চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় এলাকায়ও পরিচিত মুখ তিনি।
উচ্চমাধ্যমিকের পাট চুকিয়ে ব্যবসায় হাতেখড়ি হলো। কিন্তু ঘোড়ার নেশা তাঁর তো গেলই না, বরং দিন দিন বাড়তে থাকল। কিন্তু অশ্বারোহী হিসেবে মনের মধ্যে যে রোমাঞ্চ লালন করেন জাহেদুল, ক্ষিপ্রগতিতে ঘোড়া ছোটানোর যে বাসনা পোষণ করেন, সেভাবে তো ঘোড়া ছোটাতে পারেন না। তাহলে কী করা যায়?
ঘোড়াপ্রেমী অনেকের সঙ্গেই তত দিনে জানাশোনা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানলেন, ভারতের কানপুরে ঘোড়াচালনা প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে। যোগাযোগ করে ২০০৯ সালে কানপুরের সেই স্কুলে ভর্তি হলেন। কিন্তু কয়েকটা ক্লাস করেই বুঝলেন এখানে নতুন কিছু শেখার নেই, যা কিছু শেখানো হয়, আগে থেকেই জানেন জাহেদুল।
সেখানে থাকতে থাকতেই আরও ভালো সেন্টারের খোঁজ করতে লাগলেন। হায়দরাবাদে একটি ট্রেনিং স্কুলের সন্ধান পেলেন। সবিস্তার জেনে হায়দরাবাদের সেই স্কুলেই সাড়ে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিলেন। শিখলেন ঘোড়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পদ্ধতি, ঘোড়ায় ওঠানামা, ঘোড়াচালনা, ঘোড়া ছোটানো, ঘোড়া থামানো, ঘোড়াকে ঘোরানো ইত্যাদি।
দেশে ফিরে নিজের ঘোড়া নিয়ে মাঠে নামলেন জাহেদুল। কিন্তু ভারতে ঘোড়ায় চড়ে যে রোমাঞ্চ পেয়েছেন, নিজের বয়স্ক ঘোড়ার পিঠে বসে সেটা পাচ্ছিলেন না। বুঝলেন অল্পবয়সী ঘোড়া কিনতে হবে। কিনেও ফেললেন মাড়োয়ারি জাতের নতুন একটা ঘোড়া।
কিন্তু বাধা যেন জাহেদুলের পিছুই ছাড়ছে না। নতুন ঘোড়াটার আচরণ নিয়ে বেশ বেকায়দার পড়ে গেলেন। আচমকা কামড়ে দেয়। ডানে বললে বাঁয়ে যায়। জোরে ছোটার নির্দেশ দিলে আস্তে ছোটে—কোনোভাবেই তাকে বশে আনতে পারছিলেন না। এত দিন ঘোড়া চালানো শিখেছেন বটে, কিন্তু ঘোড়াকে বশে আনার শিক্ষা তো জাহেদুলের নেই।
সৌদিপ্রবাসী এক বড় ভাইকে সমস্যাটার কথা জানিয়েছিলেন। তিনিই পরামর্শ দিলেন, সে দেশে ভালো মানের প্রশিক্ষণকেন্দ্র আছে, সেখানে গিয়ে প্রশিক্ষণ নিতে পারেন জাহেদুল। ভাইয়ের সহযোগিতায় ভিসার ব্যবস্থাও হয়ে গেল। ২০১০ সালে চলে গেলেন সৌদি আরব। ‘আল-বদরিয়া ইকোয়েস্ট্রিয়ান স্কুল’ থেকে সাড়ে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে ফিরে এলেন অশ্বারোহী জাহেদুল।
কিছুদিনের চেষ্টায় বেয়াড়া ঘোড়াকে বশও মানালেন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত সেই ঘোড়াটাকে নিয়েই চট্টগ্রামের এখানে-সেখানে ঘুরেছেন জাহেদুল। তারপর বিক্রি করে আরও উন্নত জাতের ঘোড়া কেনেন তিনি।
ঘোড়দৌড় শিখতে চেয়েছিল বন্ধুরা
ঘোড়ায় চড়ার রোমাঞ্চ জাহেদুলের অনেক বন্ধুকেও সংক্রমিত করে। এলাকার মাঠে এই বন্ধুদের শেখাতে গিয়েই প্রথম মনে হয় প্রশিক্ষণ একাডেমি খোলার কথা। ২০১৭ সালে অবাণিজ্যিকভাবে সেটা শুরুও করেন। বিনা পয়সায় ঘোড়া চালানো শিখতে অনেকেই তাঁর কাছে আসতেন। ফেসবুকে অশ্বারোহী হিসেবে তাঁর পরিচিতও বাড়তে থাকে। বিভিন্ন ক্লাব, খামারবাড়ি থেকে মাঝেমধ্যেই ডাক আসতে থাকে। সেই ডাক কখনো ঘোড়াকে বশে আনতে, কখনোবা অশ্বারোহণ শেখাতে। ব্যবসার ফাঁকে যতটুকু সময় পান, এসব করেই কাটিয়ে দেন।
জাহেদুল বলছিলেন, ঢাকা থেকে আগ্রহী অনেক মানুষের সাড়াও পেতাম। একসময় মনে হলো বাণিজ্যিকভাবেই কাজটা শুরু করা যায়। এর মধ্যে করোনাকাল শুরু হলো। মহামারি কেটে গেলে ২০২১ সালে ঢাকায় ১০০ ফিটের কাছে এক জায়গায় শুরু করি প্রশিক্ষণ দেওয়া। ভাড়া ঘোড়া দিয়ে এটা শুরু করেছিলাম।
সেখানেই প্রশিক্ষণ নিতে এসেছিলেন উত্তরার তরুণ সৌভিক আহমেদ। ব্যবসায়ী এই তরুণের সঙ্গে মিলেই এখন পূর্বাচলের প্রশিক্ষণকেন্দ্রটি চালাচ্ছেন। বেশ সাড়াও মিলেছে। জাহেদুল এখন পুরোপুরি প্রশিক্ষণকেন্দ্রটি নিয়েই মনোযোগী হতে চান।
জেনে নিন
জাহেদুল ইসলামদের ‘হর্স রাইডিং ট্রেনিং সেন্টার’ থেকে দুটি কোর্স করা যায়। ‘রেগুলার রাইডিং’ নামের কোর্সটিতে ঘোড়ায় চড়া, ওয়াক বা হাঁটানো, ট্রট বা একটু জোরে হাঁটানো আর ক্যান্টার বা দ্রুতগতির চেয়ে কিছুটা কম গতিতে চালানোর কৌশল শেখানো হয়। এই কোর্সে ৮টি ক্লাস করানো হয়। ফি ২ হাজার টাকা। আর তিন মাসের ‘অ্যাডভান্সড কোর্সে’ ঘোড়া নিয়ন্ত্রণসহ চালানোর পাঁচটি বিষয় শেখানো হয়। জাহেদুল ইসলাম বলেন, একজন অশ্বারোহী হতে অ্যাডভান্সড কোর্সটি করতে হবে। কোর্স ফি ১০ হাজার টাকা।