সন্তান, নাতি, সবাইকে হারিয়ে যেভাবে ১২২ বছর বেঁচে ছিলেন তিনি
কত বছর বাঁচলে আমরা তাঁকে দীর্ঘায়ু বলি? ১০০? ১১০? কিন্তু যদি শোনেন কেউ বেঁচে ছিলেন ১২২ বছর! শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও বাস্তবে ফ্রান্সের জ্যঁ ক্যালমঁ পৃথিবীর স্বীকৃত প্রবীণ নারী। তিনি শুধু দীর্ঘায়ুই পাননি, বরং তাঁর জীবন ছিল ভাগ্য, বুদ্ধিমত্তা ও অধ্যবসায়ের এক আশ্চর্য গল্প। চলুন শোনা যাক।
এক শতাব্দীর সাক্ষী এক নারী
জ্যঁ ক্যালমঁ জন্মগ্রহণ করেন ২১ ফেব্রুয়ারি ১৮৭৫ সালে। ফ্রান্সের আর্ল শহরে। ভাবুন তো, তখনো আইফেল টাওয়ার তৈরি হয়নি! তার ১৪ বছর পর আইফেল টাওয়ার নির্মাণ সম্পন্ন হয়। সে সময় ফরাসি নারীদের গড় আয়ু ছিল ৪০ থেকে ৫০ বছর। অথচ জ্যঁ ক্যালমঁ সেই গড় আয়ুর প্রায় তিন গুণ বেশি পৃথিবীতে কাটিয়েছিলেন!
মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন দূরসম্পর্কের চাচাতো ভাই ফার্নান্দো ক্যালমঁকে। এই ফার্নান্দো ক্যালমঁ ছিলেন এক ধনী ব্যবসায়ী। আর্থিক সচ্ছলতা ছিল, ঘরে কাজের জন্য গৃহকর্মী ছিল, তাই জ্যঁ জীবনকে উপভোগ করতেন নিজের মতো করে। ফেন্সিং, শিকার, সাইক্লিং, টেনিস, সাঁতারসহ বিভিন্ন শখে ব্যস্ত থাকতেন তিনি।
সুখ-দুঃখে ভরা পরিবার
১৮৯৮ সালে জ্যঁর একমাত্র মেয়ে ইভন মারি নিকোল ক্যালমঁ জন্ম নেন। পরে ইভনের ঘরে জন্ম নেয় একমাত্র নাতি—ফ্রেদেরিক। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! ৩৬ বছর বয়সে ইভন প্লুরিসিতে মারা যান, আর মাত্র ৩৭ বছর বয়সে এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান ফ্রেদেরিক। একই বছরে তাঁর জামাতাও মারা যান। একে একে কাছের সব মানুষ হারিয়ে সম্পূর্ণ একা হয়ে পড়েন জ্যঁ ক্যালমঁ। তাই বলে তিনি কিন্তু থেমে থাকেননি। দৈনন্দিন সব কাজই করতেন।
অভিনব এক চুক্তি, যা ইতিহাস হয়ে গেল
১৯৬৫ সালে ৯০ বছর বয়সে আন্দ্রে-ফ্রাঁসোয়া রাফ্রে নামের এক আইনজীবীর সঙ্গে একটি ‘রিভার্স মর্টগেজ’ চুক্তি করেন জ্যঁ ক্যালমঁ। চুক্তি অনুযায়ী, রাফ্রে প্রতি মাসে জ্যঁকে ২ হাজার ৫০০ ফ্রাঁ দেবেন এবং মৃত্যুর পর তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের মালিক হবেন।
রাফ্রে ভেবেছিলেন জ্যঁ ক্যালমঁ আর কত দিন বাঁচবেন? কিন্তু এই ক্ষেত্রে ঘটনা ঘটল পুরো উল্টো!
রাফ্রে যখন চুক্তি করেন, তখন জ্যঁ তাঁর দ্বিগুণ বয়সী ছিলেন। রাফ্রের বয়স তখন ৪৭, জ্যঁর ৯০। রাফ্রে ভেবেছিলেন, কয়েক বছরের মধ্যেই অ্যাপার্টমেন্টের মালিক হবেন। কিন্তু বাস্তবে জ্যঁ তাঁকে ছাড়িয়ে যান!
৭৭ বছর বয়সে রাফ্রে মারা যান। অথচ তখনো জ্যঁ সুস্থ ও সক্রিয় ছিলেন! ফলে রাফ্রের পরিবারকে আরও দুই বছর অর্থ দিয়ে যেতে হয়। আশ্চর্যের বিষয়, এই চুক্তির ফলে জ্যঁ তাঁর অ্যাপার্টমেন্টের প্রকৃত মূল্যের দ্বিগুণ অর্থ পেয়ে যান।
দীর্ঘ জীবনের রহস্য
জ্যঁ ক্যালমেঁর জীবনযাত্রা ছিল ব্যতিক্রমী। তিনি নিয়মিত অলিভ অয়েল বা জলপাই তেল খেতেন এবং ত্বকেও ব্যবহার করতেন। যদিও তিনি সব সময় স্বাস্থ্যকর খাবার খেতেন, তবে প্রতি সপ্তাহে এক কেজি পর্যন্ত চকলেট খাওয়া ছিল তাঁর নেশার মতো!
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তাঁর জীবনযাত্রার শৃঙ্খলা। প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে ঘুম থেকে উঠতেন, শরীরচর্চা করতেন। খাবারের পর তিনি সব সময় মিষ্টান্ন খেতেন এবং সামাজিকভাবে সক্রিয় থাকতেন। একবার এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, তিনি কখনো অসুস্থ হননি।
তবে সবচেয়ে বড় রহস্য ছিল তাঁর ইতিবাচক মনোভাব। কখনো হতাশ হতেন না এবং জীবনকে পুরোপুরি উপভোগ করতেন।
এক জীবন্ত ইতিহাস
জ্যঁ ক্যালমঁ কখনো গুরুতর অসুস্থ হননি। ১১১ বছর বয়সে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠেন। ১৯৮৮ সালে ১১২ বছর বয়সে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘজীবী ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পান। এর দুই বছর পর ভিনসেন্ট ভ্যান গঘকে নিয়ে নির্মিত ‘ভিনসেন্ট এট মোই’ নামের সিনেমায় অভিনয় করেন। ফলে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে বয়স্ক অভিনেত্রী হয়ে ওঠেন।
জ্যঁ দাবি করেছিলেন, কিশোরী বয়সে তিনি তাঁর চাচার দোকানে কাজ করতেন, তখন ভ্যান গঘের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। পরে তিনি স্মৃতি হাতড়ে জানান, ‘ভ্যান গঘ ছিলেন খুব রাগী, দেখতে খারাপ, আর সব সময় মদের গন্ধ ছড়াতেন!’
১২২ বছরের এক রেকর্ড
১২০ বছর বয়সে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘজীবী ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পান। একবার এক সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনার ভবিষ্যৎ কীভাবে দেখেন?’ তিনি মজার ছলে উত্তর দেন, ‘খুব সংক্ষিপ্ত!’
১৯৯৭ সালের ৪ আগস্ট, ১২২ বছর ১৬৪ দিন বয়সে জ্যঁ ক্যালমঁ পরপারে পাড়ি জমান।
সূত্র: গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস