প্রথম হওয়া সাইফার লেখা—যেভাবে কষ্ট সার্থক হলো
বই পড়েন, লেখালেখি করেন, গানের চর্চা করেন, আবার পড়ালেখায়ও তুখোড়। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান ইউনিটের (খ ইউনিট) ভর্তি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন ঢাকার হলি ক্রস কলেজের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সাইফা বিনতে ওয়ারীশ। কীভাবে ‘ভর্তিযুদ্ধে’ সাফল্য পেলেন, স্বপ্ন নিয়ের অনুরোধে লিখেছেন তিনি।
ছোটবেলায় যখন স্কুলে পড়ি, তখন আশপাশের অনেকেই অনেক কিছু হতে চাইত। আমি তখনো এসব বুঝতাম না। মা–বাবাও কখনো বলেনি, তোমাকে এটাই হতে হবে। নবম শ্রেণিতে উঠে কী মনে করে বিজ্ঞান পড়া শুরু করলাম। ডাক্তার-প্রকৌশলী হওয়ার ইচ্ছা থেকে নয়, এমনিই। ছোটবেলা থেকেই ইংরেজি আমার পছন্দ। যখন দেখলাম, ইংরেজি সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ করা যায় মানবিক বিভাগে, তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, কলেজে বিভাগ পরিবর্তন করে মানবিক নেব। এর পর থেকে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি প্রস্তুতি শুরু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা, আইন ও সামাজিক বিজ্ঞান (সাবেক ‘খ’) ইউনিটের প্রশ্ন নিয়ে গবেষণা শুরু করি। কী ধরনের প্রশ্ন আসে, কেমন প্রশ্ন হয়—একটু একটু করে বুঝতে শিখি।
এসএসসির পর ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি পুরোদমে শুরু হলো। ছোটবেলা থেকে ধরে ধরে পড়ার কারণে ইংরেজি সহজ লাগত। পাশাপাশি বাংলা ও সাধারণ জ্ঞানের দিকে মনোযোগ দিলাম। এভাবে এইচএসসির আগেই ভর্তি পরীক্ষার পুরো সিলেবাস শেষ হয়ে যায়।
উচ্চমাধ্যমিকের পরীক্ষা শেষ করে কোচিংয়ে ভর্তি হলাম। কোচিংয়ে ক্লাস শুরু হওয়ার আগে হাতে কিছুদিন সময় ছিল। সেই সময়টা রিভিশন দেওয়ার কাজে ব্যয় করি। দেখা গেল, কোচিং ক্লাস শুরুর আগেই আমার ইংরেজি ও সাধারণ জ্ঞান একবার করে রিভিশন শেষ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় লিখিত অংশের গুরুত্ব অনেক। আমি শুরু থেকেই লিখিত অংশে দক্ষ ছিলাম। ছোটবেলায় গল্পের বই পড়া এবং তা থেকে টুকটাক লেখালেখির যে অভ্যাস গড়ে উঠেছিল, তার সুফল আমি এই সময় পেয়েছি।
ভর্তি পরীক্ষার পুরো চার মাস স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নশীল থাকার চেষ্টা করেছি। পর্যাপ্ত ঘুমানো, বিশ্রাম, শরীরচর্চা ও মন ভালো রাখতে সংগীতচর্চা করাকে প্রাধান্য দিয়েছি। আসলে ছোটবেলায় গান শিখতাম, সেটাই বাড়িতে চর্চা করেছি। আধুনিক গান, রবীন্দ্রসংগীত বেশি করা হতো। পড়তে পড়তে মনোযোগ ধরে রাখতে না পারলে বিরতি নিয়ে কিছু সময় গিটারও বাজাতাম। এতে যা হতো, পরে যখন পড়তে বসতাম, তখন মনোযোগ পুরোপুরি ধরে রাখতে পারতাম। পড়ার সময় কঠিন ও সহজ বিষয় আলাদা করে নিতাম। আগেও বলেছি, ইংরেজি আমার কাছে সহজ মনে হতো। তাই ইংরেজির তুলনায় বাংলা ও সাধারণ জ্ঞানে বেশি সময় দিয়েছি। পরের দিন কী কী পড়ব, আগের দিন ডায়েরিতে সেটা নোট করে রাখতাম। চেষ্টা করতাম ভোরবেলা উঠে পড়ার, দিনের বেশির ভাগ পড়া (বিশেষ করে সাধারণ জ্ঞান) তখনই শেষ করে ফেলার। এভাবে প্রতিদিন পড়তাম। ভুলে যাওয়া পড়া বারবার রিভিশন দিতাম।
দেখতে দেখতে পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এল। পরিকল্পনা অনুযায়ী, সহজ প্রশ্নগুলো প্রথমে উত্তর করলাম। এরপর যেগুলো একটু চিন্তা করতে হয়, সেগুলোর দিকে মন দিলাম। পরীক্ষা শেষে দেখা গেল, ভেবেচিন্তে পরে উত্তর করা প্রশ্নের অধিকাংশ সঠিক হয়েছে। বহুনির্বাচনী ও লিখিত—উভয় অংশই মনমতো হয়েছিল। ভেবেছিলাম, ইংরেজি অংশে ১৫টার ১৫টাই হবে। এই ধারণা পরে মিলে যায়। সাধারণ জ্ঞানও ৩০টাই হবে মনে করেছিলাম। পরে দেখলাম, দুইটা ভুল হয়েছে। মনে আশা জাগতে শুরু করল, সৃষ্টিকর্তা চাইলে আমি মেধাতালিকায় স্থান পাবই।
ফল প্রকাশের দিন। কাঁপা কাঁপা হাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে লগইন করি। মুহূর্তেই স্ক্রিনের ওপর ফলাফল এল। একবার মনে হলো, স্বপ্ন দেখছি। কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে যখন আবার দেখলাম, মনে হলো, আমার গত কয়েক বছরের নিরলস পরিশ্রম, ত্যাগ ও বাবা-মায়ের আশা শেষ অবধি পূরণ হয়েছে। সার্থক হয়েছে আমার কষ্ট।