ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যেভাবে র‍্যাঙ্কিংয়ে এগিয়েছে

কিউএস র‍্যাঙ্কিংয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বসেরা ৬০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় উঠে এসেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৯ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্তও ৮০১-১০০০–এর মধ্যে ছিল তাদের অবস্থান। কীভাবে অর্জিত হলো এই অগ্রগতি? সামনে আরও এগোতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পরিকল্পনাই–বা কী? আগামীকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস সামনে রেখে আজ থাকল বিশেষ আয়োজন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

কাল ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর প্রাক্কালেই এসেছে সুখবর—আন্তর্জাতিক র‍্যাঙ্কিংয়ে প্রথমবারের মতো সেরা ছয় শর ঘরে প্রবেশ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কোন্দল-দলাদলি, বাজেট–স্বল্পতাসহ নানা সংকটে জর্জরিত এ বিশ্ববিদ্যালয়–সংশ্লিষ্টদের জন্য এই সামান্য উত্তরণও একটা সুখবর।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক শিক্ষা ও গবেষণা সংস্থা কোয়াককোয়ারেলি সায়মন্ডসের (কিউএস) ৪ জুন প্রকাশিত সর্বশেষ র‍্যাঙ্কিংয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান এখন ৫৫৪। গত বছরও এই র‍্যাঙ্কিংয়ে সাত শর ঘরে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বব্যাপীই কিউএসের র‍্যাঙ্কিংকে মনে করা হয় সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য।

গত এক যুগের র‍্যাঙ্কিং পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই সময়ে (২০১২–২৪) কিউএস র‍্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই ছয় শর ঘরে উঠতে পারিনি। ২০১৯ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান ছিল আট শরও পরে। গত বছর থেকে র‍্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি হচ্ছে। গত বছর কিউএস র‍্যাঙ্কিংয়ে ৬৯১-৭০০তম অবস্থানে ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

৯টি সূচকে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক মান নিরূপণ করে কিউএস। সূচকগুলো হলো একাডেমিক খ্যাতি, শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতি, কর্মসংস্থান, চাকরির বাজারে সুনাম, শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাত, আন্তর্জাতিক শিক্ষকের অনুপাত, আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক, আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর অনুপাত এবং স্থায়িত্ব। প্রতিটি সূচকে ১০০ করে স্কোর। ২০২৫ সালের জন্য প্রকাশিত র‍্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক স্কোর ২২ দশমিক ৪০।

দুই সূচকে বড় অগ্রগতি

সর্বশেষ র‍্যাঙ্কিংয়ের সূচকভিত্তিক স্কোরের সঙ্গে গত বছরের স্কোরের তুলনা করে দেখা গেছে, মূলত দুটি সূচকে এবার বড় অগ্রগতি হয়েছে—কর্মসংস্থান ও আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক। কর্মসংস্থানে গতবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কোর ছিল ৩০ দশমিক ৩০। এবার ৯৩ দশমিক ৭০। আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্কে গত বছরের স্কোর ছিল ২ দশমিক ১০। এবার ৫২। এ ছাড়া একাডেমিক খ্যাতি, শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতি ও স্থায়িত্ব সূচকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কোরও এবার সামান্য বেড়েছে।

কিউএসের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, একাডেমিক খ্যাতি সূচকে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার গুণগত মান, সেগুলো ছড়িয়ে দেওয়ার সক্ষমতা ও গবেষণার প্রভাব দেখা হয়। ‘চাকরির বাজারে সুনাম’ সূচকে দেখা হয় ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকেরা কতটা নিয়োগযোগ্যতা অর্জন করেছেন? শিক্ষকপ্রতি গবেষণা-উদ্ধৃতিতে প্রতিষ্ঠানটিতে কতটা গবেষণা হয়, তা দেখা হয়। সঙ্গে গবেষণার বাজেট ও প্রতিষ্ঠানের আকারও বিবেচনায় থাকে।

কর্মসংস্থান সূচকে একটি বিশ্ববিদ্যালয় তার স্নাতকদের কর্মক্ষেত্রে নিয়োগযোগ্যতা কতটা নিশ্চিত করতে পেরেছে, তা মূল্যায়ন করে কিউএস। নিজ নিজ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দেওয়া ও প্রভাব রাখতে বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর স্নাতকদের কতটা শিক্ষা দিতে পারছে, তা-ও মূল্যায়ন করা হয় এ সূচকে। এ ক্ষেত্রে দুটি মানদণ্ড বিবেচনা করা হয়। একটি হচ্ছে স্নাতকদের কর্মসংস্থানের হার। এতে দেখা হয়, প্রতিষ্ঠানটির কত শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ করার ১৫ মাসের মধ্যে কর্মজীবনে প্রবেশ করছেন। দ্বিতীয়টি হচ্ছে অ্যালামনাইদের প্রভাব। এ ক্ষেত্রে স্থানীয় ও বৈশ্বিক সমাজে অর্থপূর্ণ প্রভাব রাখতে পারছেন, একটি প্রতিষ্ঠানের এমন প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের রেকর্ড দেখা হয়। এ জন্য ব্যবসা, রাজনীতি, উচ্চশিক্ষা ও দাতব্যকাজে যুক্ত ৮২ হাজারের বেশি স্নাতকের প্রোফাইল যাচাই করে তাঁরা কোথায় উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন, তা দেখা হয়।

বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ সমাধান এবং আরও বড় পরিসরে গবেষণাকে পৌঁছে দিতে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণা-সহযোগিতা কতটা জোরদার করতে পেরেছে, তা মূল্যায়ন করা হয় আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক সূচকে।

কিউএস র‍্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বড় লাফের’ নেপথ্যে মূল ভূমিকা রেখেছে সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগ
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

‘বড় লাফের’ নেপথ্যে

কিউএস র‍্যাঙ্কিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বড় লাফের’ নেপথ্যে মূল ভূমিকা রেখেছে সাম্প্রতিক কিছু উদ্যোগ। এর মধ্যে প্রধান দুটি হলো স্বীকৃত আন্তর্জাতিক জার্নালে গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশে শিক্ষকদের অনুদান দেওয়া এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক পরিচিতি বাড়াতে বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সহায়তা ও যোগাযোগ বাড়ানো। এ ছাড়া গবেষণায় চৌর্যবৃত্তি প্রতিরোধে নীতিমালাও করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

২০২১ সালের ২৯ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটের এক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মৌলিক ও প্রায়োগিক গবেষণার মান ও পরিধি বাড়াতে ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরসংবলিত আন্তর্জাতিক জার্নালে শিক্ষক ও গবেষকদের গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশনার জন্য অনুদান দেওয়া হচ্ছে। গবেষণা-প্রবন্ধ ছাপানোর খরচ জোগাতেই মূলত এই অনুদান দেওয়া হচ্ছে। কেননা স্বীকৃত সব আন্তর্জাতিক জার্নালেই গবেষণা-প্রবন্ধ প্রকাশের জন্য নির্দিষ্ট ফি দিতে হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাবলিকেশন প্রসেসিং ফির সমপরিমাণ অর্থ কিংবা ওপেন অ্যাকসেস ফি হিসেবে সর্বোচ্চ দুই হাজার ডলার (প্রায় ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা) পর্যন্ত অনুদান দেওয়া হচ্ছে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে অন্তত ২ ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর আর অন্যান্য বিষয়ে অন্তত ১ ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টরসংবলিত জার্নালে গবেষণা ছাপাতে অনুদান দিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সর্বশেষ র‍্যাঙ্কিংয়ে এর প্রভাবও পড়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এস এম মাকসুদ কামাল বলেন, ‘গত দুই বছরের তুলনায় ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর জার্নালে আমাদের প্রকাশনা প্রায় তিন গুণ বেড়েছে। গবেষণা নিয়ে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করেছি, সেই নীতিমালার সুফল পাওয়া শুরু করেছি। শিক্ষকদের গবেষণা বেড়েছে, যা র‍্যাঙ্কিংয়ে অবদান রাখছে। এর বাইরেও আমরা এখন প্রতিটি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে ৩০ শতাংশ শিক্ষার্থীর স্নাতকোত্তর পর্যায়ে থিসিস করা বাধ্যতামূলক করেছি। আগে আমাদের ওয়েবসাইটে বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি ছিল। এখন ওয়েবসাইট হালনাগাদ করা হয়েছে। এখনো ঘাটতি আছে। এগুলো পূরণের চেষ্টা করছি। আরও তথ্য-উপাত্ত দিয়ে আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট সমৃদ্ধ করতে পারি, পাশাপাশি গবেষণা আরও বাড়াতে পারি, তাহলে আগামী বছর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও উন্নতি হবে বলে আশা করি।’

র‍্যাঙ্কিংয়ে এগোনোর উদ্যোগ

আন্তর্জাতিক পরিসরে গবেষণা-সহযোগিতা জোরদারেও নানা পদক্ষেপ নিয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক সূচকে বিশ্ববিদ্যালয়ের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। গত এপ্রিলে জাপান ও মে মাসে যুক্তরাজ্য সফর করেন উপাচার্য মাকসুদ কামাল। তিনি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক গবেষণা নেটওয়ার্ক সূচকে আমাদের স্কোর বেড়েছে; কারণ, আমরা এখন একযোগে কাজ করা বাড়িয়েছি। কিছু বিভাগের শিক্ষক বিদেশে যেখানে পিএইচডি করে এসেছেন, এখন সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে গবেষণা করছেন। সম্প্রতি আমি যুক্তরাজ্য ও জাপানের কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলাম। সেখানেও যৌথ গবেষণার বিষয়ে আমরা আলোচনা করে এসেছি। বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানে নিতে আমরা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কিং জোরদারের উদ্যোগ নিয়েছি। সেটা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা আছে।’

গবেষণায় ভালো করায় কিউএস কর্মসংস্থান সূচকেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিছুটা গুরুত্ব পেয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। উপাচার্য অবশ্য জানালেন, কিউএস দৈবচয়নের ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের ই–মেইল করে তাঁদের মতামত সংগ্রহ করে। মতামতের ভিত্তিতেই এই সূচকে স্কোরিং করা হয়। এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে তথ্য-উপাত্ত দেওয়ার সুযোগ নেই।