মাঝসাগরে উঁচু উঁচু ঢেউয়ের সঙ্গে লড়াই করে ফেরার পথে ট্রলারের ইঞ্জিনটা বিকল হয়ে গেল
গভীর বঙ্গোপসাগরে ঝড়ের কবলে পড়েছিল ‘মায়ের দোয়া’। উঁচু উঁচু ঢেউয়ের তোড়ে মাঝিমাল্লাসহ মাছ ধরার ট্রলারটা একসময় ভারতের জলসীমাতেও ঢুকে পড়ে। ঝড় থামলে তীরে ফেরার পথে বিকল হয়ে যায় ট্রলারের ইঞ্জিন। এরপর কী হলো? মাঝি খলিলুর রহমান ফকিরের কাছে সেই গল্প শুনেছেন এ কে এম ফয়সাল
পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার হোগলপাতি গ্রামে আমার বাড়ি। ৫৫ বছরের জীবনে ৩৭ বছর সাগরেই কাটায়া দিলাম। কত মানুষের সঙ্গেই না ট্রলারে উঠছি। কত ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সামনে পড়ছি। একসময় নিজেই মাঝি হইলাম, তখন মহাজনের ট্রলার নিয়া সাগরে যাইতাম। দুই বছর হয় নিজের একটা ট্রলার হইছে। এখন আমার সঙ্গে সাগরে মাছ ধরে তিন ছেলে—মানিক ফকির, হেলাল ফকির আর দুলাল ফকির। এই কাজই আমাদের রুটিরুজি।
কয় দিন আগে সরকারের মাছ ধরার দুই মাসের নিষেধাজ্ঞা শেষ হইছে। তার আগে থেকেই অবশ্য আমরা ট্রলার রেডি করছি। প্রতিবার মৌসুম শুরুর আগেই ট্রলারে কাজ করা লাগে। পরিকল্পনা মতো গত ২৯ জুলাই ভোরে তিন ছেলেসহ নয়জন ট্রলারে উঠি। বাড়ি থেকে প্রথমে যাই বরগুনার পাথরঘাটার চরদোয়ানী বাজারে। এই বাজার সামুদ্রিক মৎস্য অবতরণ কেন্দ্র, এই কারণে সমুদ্রগামী ট্রলারের যাবতীয় জিনিসপত্রও এখানে পাওয়া যায়। চরদোয়ানী বাজার থেকে চাল, ডাল, তেলসহ সাত দিন চলার মতো জিনিসপত্র কিনি। এরপর আরও অনেক ট্রলারের মতো আমরাও সাগরের উদ্দেশে ঘাট ছেড়ে যাই।
সাগরে ভাসাইলাম তরি
ট্রলার ছাড়ার পর হাল ধরে থাকা ছাড়া আর তেমন একটা কাজ থাকে না। খাইদাই, গল্পগুজব করি। নেটওয়ার্ক থাকা পর্যন্ত পরিবারের সঙ্গে কথাবার্তাও হয়। সেদিনও এভাবেই একটানা ৯ ঘণ্টা ট্রলারে চলার পর বেলা তিনটার দিকে বঙ্গোপসাগরের ১০ নম্বর বয়ার (সাগরে ভাসমান নির্দেশনা) কাছে পৌঁছাই। তারপর জাল ফেলি। ইলিশ, রূপচাঁদা, পোয়া, পারশেসহ নানা জাতের মাছ ওঠে। পরদিনও ঘুরে ঘুরে জাল ফেলি। খুব একটা মাছ ধরা পড়ে না। মনটা একটু খারাপই হয়। দুই মাস পর সাগরে আইসা মাছ না পেলে হতাশ লাগাই তো স্বাভাবিক। ৭০ হাজার টাকা খরচা করে এবার নাও ভাসাইছি। তার আগে ট্রলার ঠিক করতে গেছে আরও কতগুলো টাকা। কপাল!
গত ৩১ জুলাই বেলা সাড়ে তিনটার দিকে আবার জাল ফেলি। ভালো আবহাওয়া দেইখা জাল ফেলছিলাম, সন্ধ্যার পর থেকেই আবহাওয়া খারাপ হওয়া শুরু করল। সবাই মিলে টেনে টেনে দ্রুত জাল তোলার চেষ্টা করি। বৃষ্টি বাইড়া গেল। রাত ১০টার পর শুরু হইল ঝড়। প্রচণ্ড ঝড়। সন্ধ্যায় যখন আবহাওয়া খারাপ করল, বুঝতে পারি নাই রাতে এমন ঝড় হবে। বাতাস আর বড় বড় ঢেউয়ে ট্রলারের হাল ধরা মুশকিল হইয়া পড়ছিল। এই সময় ট্রলার নোঙর করাও ঠিক না, ঢেউয়ের ধাক্কায় উল্টে যেতে পারে। তাই ইঞ্জিনও বন্ধ করে দিই। ঢেউয়ের সঙ্গেই তাল মিলাইতে থাকলাম। ট্রলারটা নিজের মতো চলতে থাকল।
ইঞ্জিন বন্ধ। অন্ধকারে কোন দিকে যাচ্ছি, কিছুই বুঝতে পারছি না। সবাই মিলে আল্লাহর কাছে জীবন ভিক্ষা চাইতে থাকি। মানত করলাম, বেঁচে ফিরতে পারলে ছাগল জবাই করে ছদকা দেব। এই ঝড়ের মধ্যে কিসের রান্না, কিসের খাওয়া। জীবনের আশাই ছাইড়া দিছি। একটা ঢেউ ট্রলারের ওপরে পড়লেই সব শেষ। এত বড় বড় ঢেউ, যে নিজেকে সামাল দিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়ল। মনে হলো, পরিবারের সঙ্গে শেষবার কথা বলি। কিন্তু নেটওয়ার্কই তো নাই, কথা বলব কি। ৩৭ বছরে এত ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখোমুখি কোনো দিন হই নাই। অতীতে ঝড়ের আগে পূর্বাভাস পেয়ে নিরাপদে কোথাও ট্রলার নোঙর করে থাকছি। এবার ঝড়ের আগে কোনো বিপৎসংকেত পাই নাই।
ভাসতে ভাসতে ভারত
সারা রাত ঝড়ের মধ্যে গেল। ১ আগস্ট ঝড় থামলে বুঝতে পারলাম, ট্রলার ভারতে ঢুকে পড়ছে, কিন্তু সাগর তখনো উত্তাল। ভারতীয় নৌবাহিনীর টহল দল আমাদের আশপাশেই ছিল, তারা হয়তো বুঝতে পেরেছিল বিপদে পড়ে আমরা তাদের সীমায় গেছি, তাই কাছে আসে নাই।
সকালে সাগর একটু শান্ত হলে ইঞ্জিন চালু করি। চলতে থাকে ট্রলার। সবাই রাতভর জীবন বাজি রেখে ট্রলার সামলে দুর্বল হয়ে পড়েছে। আমরা তখন তীরে ফিরে যেতে পারলেই বাঁচি। মাছ আর এবার ধরতে হবে না। এক দিন পর ট্রলারে রান্না হলো। পেট ভরে খেলাম।
রাতভর ট্রলার চলল। কূলকিনারা নাই। কোনো ট্রলারের সঙ্গেও দেখা হইল না। তারপরও ২ আগস্ট সকালে মনটা কেন যেন ভালো হয়ে গেল। মনে হলো, এই যাত্রায় বেঁচে গেলাম। আরও কয়েক ঘণ্টা ট্রলার চলার পর দেখি মুঠোফোনে নেটওয়ার্ক আসছে। গত কয়েক দিন যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। না জানি বাড়ির মানুষেরা কত দুশ্চিন্তায় আছে। যখন ভাবছি কল দেব, তখনই হঠাৎ ইঞ্জিনটা বন্ধ হয়ে গেল। ইঞ্জিনের কাছে গিয়ে দেখি মবিলের পাইপটা ফেটে গেছে। সারানোর চেষ্টা করেও লাভ হলো না। অকূল দরিয়ায় ট্রলারটি আবার ভাসতে থাকল। হায়রে নিয়তি। এক ঝড় থেকে বেঁচে পরিবারের কাছে যখন ফিরে আসছি প্রায়, তখনই আরেক বিপদ এসে হাজির।
দূরে একটা ট্রলার দেখা যায়
সবাই হতাশ হয়ে পড়ল। কী হবে এখন, কী করা যায়। আমি জানি, বিপদে মাথা ঠান্ডা রাইখা আল্লাহকে ডাকা ছাড়া কিছুই করার নাই। সেটাই ছেলেসহ অন্য মাল্লাদের বললাম। কিছু হইলে আমার পুরা পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাবে। আমার স্ত্রী, ছেলের বউয়েরা প্রতিবার সাগরে আসার সময়ই বলে, এক ট্রলারে কেন সবাই যাও। কোনো কিছু হলে গোটা পরিবারের কী হবে? কিন্তু ছেলেদের সঙ্গে না এনে কী করব, এত টাকাপয়সা নেই যে অন্য জেলেদের নিয়ে যাব। বাধ্য হয়েই তো সাগরে আসি।
বাড়িতে কল দিয়ে অবশ্য বিপদের কথা বললাম না। শুধু জানালাম, আমরা ঠিকঠাক আছি, বাড়ি ফিরতেছি। ওপাশে সবাই কান্নাকাটি করছে, কয়টা দিন নাকি মহা দুশ্চিন্তায় কাটছে। নিজে বিপদে থেকেও ওদের সান্ত্বনা দিলাম। ভাসতে থাকা ট্রলারে নিয়তির কাছে নিজেদের ছেড়ে দিলাম। মনে মনে আশায় বুক বাঁধি আর ভাবি, দেশের মধ্যে আছি, নেটওয়ার্কও পাওয়া গেছে, তীরে হয়তো ভিড়বই। রাতভর আকাশে তাকিয়ে কেটে গেল। ট্রলারে খাবারদাবার আছে, অল্প অল্প করে খাই। আশপাশে কোনো ট্রলার নজরে আসে না।
৩ আগস্ট, দুপুর। হঠাৎ দেখি একটা ট্রলার। আস্তে আস্তে আমাদের দিকেই আসতেছে। আমরা নানাভাবে তাদের ইশারা দিতে থাকি। ট্রলারের লোকজন হয়তো বুঝতে পারে বিপদে আছি। একসময় ট্রলারটা আমাদের কাছে আসে। তারা এসে পরিচয় দেয়, বন বিভাগের বনরক্ষী। টহল দলটি আমাদের দুর্ঘটনার কথা শুনে তাদের ট্রলারে তুলে নেয়। তারপর আমাদের বিকল ট্রলারটাকে তাদের ট্রলারের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বেঁধে তীরের দিকে যেতে থাকে।
গত কয় দিনে কতবার যে মনে হইছে, আর হয়তো বাড়ি আসতে পারব না। এখন মনে হলো এবারের মতো বেঁচে গেলাম। আমরা এসে নামি সাতক্ষীরা রেঞ্জের সুন্দরবনের মান্দাবাড়িয়া এলাকায় বন বিভাগের কার্যালয়ে। সেখান থেকে মোংলা। ধারদেনা করে ট্রলার ঠিকঠাক করি। ট্রলারে যা মাছ ছিল ২৭ হাজার টাকায় বিক্রি করি। খরচের টাকা না উঠলেও বেঁচে ফেরার আনন্দ নিয়েই ৪ আগস্ট বাড়ি ফিরি। আমরা জেলে, এই আমাদের জীবন। এত অনিশ্চয়তার পরও আবার হয়তো কয় দিন পরই আমরা সাগরে যাব।
(এই লেখা যখন প্রকাশিত হচ্ছে, তখন তিন ছেলেকে নিয়ে ট্রলারে বঙ্গোপসাগরে আছেন খলিলুর রহমান ফকির মাঝি)