মেট্রোরেলের স্টেশনে ডা. ফেরদৌসীর হাতে যেভাবে জন্ম নিল শিশুটি

ফেরদৌসী আক্তারের কোলে সেই নবজাতক
ছবি: সংগৃহীত

ফেরদৌসী আক্তার শিশু হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক। বাসা উত্তরা। কর্মস্থল শ্যামলী। লম্বা পথ। নিয়মিতই এ দূরত্ব পাড়ি দেন ফেরদৌসী আক্তার। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর থেকে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোতে যান। ১২ জানুয়ারি সকালেও সেমতোই বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। তবে পরপর দুটি ট্রেন মিস হয়ে যায়। তৃতীয় ট্রেনে উঠতে উঠতে সকাল ৮টা ২০ মিনিট বেজে যায়।
বগিতে উঠেই ফেরদৌসীর চোখে পড়ে, ব্যথায় কাতরাচ্ছেন এক অন্তঃসত্ত্বা সহযাত্রী। চিকিৎসকের চোখ। দেখেই বুঝতে পারলেন প্রসব আসন্ন। তাই কাছে গিয়ে তাঁর শারীরিক সুবিধা-অসুবিধার কথা জানতে চাইলেন। সোনিয়া রানী নামের সেই নারী জানান, সকাল থেকে ব্যথা উঠলেও পানি ভাঙেনি। তাই মেট্রোতে আগারগাঁও পর্যন্ত গিয়ে সেখান থেকে গাড়ির ব্যবস্থা করে ধানমন্ডিতে নির্ধারিত হাসপাতালে প্রসবের জন্য যাচ্ছেন তাঁরা।

আরও পড়ুন

কথাবার্তা বলে মিনিট দশেক পরে কিছুটা নিশ্চিন্ত মনেই আগারগাঁও স্টেশনে নামলেন ফেরদৌসী। তবে স্টেশনের চলন্ত সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় দেখলেন, লিফটে করে নেওয়া হচ্ছে সেই অন্তঃসত্ত্বাকে। কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য পরের তলার সিঁড়িতে পা রাখবেন, নাকি ওই নারীর কাছে যাবেন? নিমেষে মনস্থির করে ফেললেন ফেরদৌসী। দ্রুত ছুটলেন সেই অন্তঃসত্ত্বার কাছে।

ফেরদৌসী আক্তার
ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন



রুদ্ধশ্বাস কয়েকটা মুহূর্ত
নষ্ট করার মতো সময় হাতে নেই। বিজ্ঞানসম্মত প্রসবের জন্য যেসব সরঞ্জাম প্রয়োজন, হাতের কাছে সেগুলোর কিছুই নেই, আশপাশে কী আছে, দেখারও সময় নেই। রোগীকে হাসপাতালে পাঠানোর মতো সময়ও নেই, স্টেশনেই প্রসব করাতে হবে। রোগীকে দ্রুত শোয়ানো হলো স্টেশনের ফার্স্ট এইড সেন্টারে। ওড়নার টুকরা আর পরিচ্ছন্নতাকর্মীর চাদর দিয়ে কক্ষটির স্বচ্ছ দরজা ঢেকে দেওয়া হলো। ইতিমধ্যে নবজাতকের মাথাটি দৃশ্যমান হয়েছে। ফেরদৌসীর চিকিৎসক পরিচয় তখনো কেউ জানে না। প্রসবে সাহায্যকারী পরিচ্ছন্নতাকর্মী নাড়ি বাঁধার বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করলে প্রথমবারের মতো নিজের পরিচয় দিলেন ফেরদৌসী। এবার আর অমতের সুযোগ থাকল না। রোগীর স্বজনের দেওয়া ওড়নার টুকরা দিয়েই বাঁধা হলো নাড়ি, শক্ত বাঁধন দিয়ে নাড়ি কাটাও হয়েছে। নবজাতকের হাত-পাগুলো নীলচে দেখাচ্ছে। নবজাতকের প্রথম কান্নার জন্য বৈজ্ঞানিকভাবে উদ্দীপনা দিলেন ফেরদৌসী। কান্নার পরেও নীলচে ভাব থেকে গেল। নবজাতকের গায়ে প্রথমে জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল মেট্রো স্টেশনে থাকা রোভার স্কাউটের স্কার্ফ। এরপর রোগীর স্বজনদের আনা তোয়ালেতে তাকে প্যাঁচানো হলো। শিশুর প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং জীবনসঞ্চারী প্রাথমিক চিকিৎসাও (রিসাসিটেশন) দিলেন ফেরদৌসী।

প্রসূতির অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়নি, পালস স্বাভাবিক, একটু নীলচেভাব থাকলেও নবজাতকও সুস্থ আছে, মোটের ওপর কোনো জটিলতা ছাড়াই প্রসব করানো গেছে। সব মিলিয়ে নিঃসন্দেহে এটি সফল প্রসব। ভালো লাগার অনুভূতিতে ভরে গেল ফেরদৌসীর মন। তবে এরপরও ঝুঁকি নেননি। তাঁদের সঙ্গেই অ্যাম্বুলেন্সে রওনা হলেন ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে। হাসপাতালে নবজাতকদের জন্য যে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র, সেখানকার চিকিৎসকের দায়িত্বে নবজাতককে রেখে তবেই ছুটি।

মা ও নবজাতককে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে তবেই ‘ছুটি’ নিয়েছেন ডা. ফেরদৌসী
ছবি: সংগৃহীত



ছুটি নয়, কাজের শুরু—জীবনটাই এমন
ফেরদৌসী আক্তার বলেন, ‘হাসপাতালে আসতে যে একটু দেরি হবে, ফোনে সেটা জানিয়ে দিয়েছিলাম। বলেছি, একটি জরুরি পরিস্থিতিতে পড়ে গেছি। সব শেষ করে সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ নিজের কর্মস্থলে ফিরি।’ দিনের বাকি সময়টা কাজ করেছেন যথারীতি। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার চূড়ান্ত ধাপের কাজ চলছে। গাজীপুরের ভাওয়াল মির্জাপুর হাজী জমির উদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় এবং উত্তরার মাইলস্টোন কলেজে পড়ালেখা শেষে শুরু করেন চিকিৎসক হওয়ার লড়াই। উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজ থেকে ২০১৫ সালে এমবিবিএস করেছেন। ও, ভালো কথা! ফেরদৌসীর দুই বছর বয়সী একটি মেয়েও আছে। ফলে সন্তান জন্ম দেওয়ার কষ্ট ও আনন্দ—দুই–ই তাঁর ভালো জানা আছে।

নবজাতকের দাদি ও মা-বাবা অকুণ্ঠ কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। ফেরদৌসীর পরিবার, বন্ধু ও সহকর্মীরাও দারুণ খুশি। সেদিন ক্লাসে বসেই প্রথম অভিনন্দনবার্তাটি পেয়েছিলেন উত্তরা আধুনিক মেডিকেল কলেজের এক অনুজের কাছ থেকে। পরিচিত, অর্ধপরিচিত এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের চিকিৎসকমহলও শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। তাঁর পরিবারের সদস্যরাও কিন্তু ঘটনাটি জেনেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাঁকে ‘ট্যাগ’ করা একটি ‘পোস্ট’ থেকে। এ ঘটনার পর বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের পরিচালক প্রতিষ্ঠানটির অন্য চিকিৎসকদের সঙ্গে তাঁকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। হাততালি দিয়ে ফেরদৌসীকে বিশেষ সম্মাননা জানিয়েছেন সবাই।

চিকিৎসক হিসেবে ফেরদৌসীর চাওয়া
ফেরদৌসী আক্তার বলেন, ‘সেদিনের সেই জরুরি সময়ে মেট্রোরেলের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ বাড়িয়ে দিয়েছে সহযোগিতার হাত। রোভার স্কাউটদের সহায়তাও পেয়েছি। সেদিন শেষ পর্যন্ত সবই যদিও ঠিকঠাক ছিল, কিন্তু এমন ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি কোনোভাবেই কাম্য নয়; বরং প্রতিটি নবজাতকের প্রসব হওয়া উচিত পরিকল্পিত।’ ফেরদৌসী আক্তার তাই মনে করেন, সেদিনের ঘটনায় নবজাতক কিংবা মা—যে কারও জীবনই ঝুঁকিতে পড়তে পারত। তাই প্রসববেদনা শুরু হয়ে গেলে অন্তঃসত্ত্বাকে দ্রুত নিকটস্থ হাসপাতালে নেওয়া উচিত। আর বাসা থেকে দূরের কোনো হাসপাতালে প্রসব করানোর পরিকল্পনা থাকলে সম্ভাব্য তারিখের আগেই সেখানে চলে যাওয়া উচিত।