চট্টগ্রাম থেকে গিয়ে কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শহরের মেয়র হলেন তৈয়ব

যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া রাজ্যের একটি শহর মিলবোর্ন। এই শহরের মেয়র চট্টগ্রামের সন্তান। বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে এসে কীভাবে একটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত হলেন, সেই গল্প শুনে এসেছেন ওমর কায়সার

মিলবোর্নে নিজ কার্যালয়ে মাহবুবুল আলম তৈয়ব
ছবি: প্রথম আলো

নিউইয়র্ক আন্তর্জাতিক বইমেলার শেষ দিন ২৭ জুন কবিবন্ধু এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা মনোমানচিত্রর সম্পাদক আলী সিদ্দিকীর সঙ্গে গিয়েছিলাম পেনসিলভানিয়া। নিউইয়র্ক থেকে প্রায় ১৬৭ কিলোমিটার দূরে শান্ত–নিরিবিলি–ছিমছাম শহর ল্যান্সডেলে তাঁর বাসা। ওখানে কবিতায়, গানে, আড্ডায় দিন কাটছিল। একদিন বিকেলে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক মাধবচন্দ্র দাশ ফোন করেন। কয়েক বছর হয় শিক্ষাছুটিতে এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজ করছেন তিনি। তাঁর বাসাও পেনসিলভানিয়াতেই, তবে একটু দূরে। ফিলাডেলফিয়া সিটির কাছে কাউন্টি ডেলাওয়্যারের মিলবোর্ন শহরে। তাঁর বাসায় আমন্ত্রণ জানালেন। আমন্ত্রণ কবুল করি।

বন্ধু আলীকে নিয়ে নির্ধারিত দিন বেরিয়ে পড়া গেল। একটা শহরে ঢোকার পথে হঠাৎ দেখি সড়কের নাম বাংলাদেশ!

প্রায় চিৎকার দিয়ে বললাম, দেখ দেখ। 

আমার এই প্রতিক্রিয়াটার জন্যই যেন অপেক্ষা করছিল আলী, ‘হুম, এই চমকটা তোমার জন্য রেখেছিলাম। আগে কিছু বলিনি। আমরা যে শহরে ঢুকলাম, তার নাম মিলবোর্ন। অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্নের সঙ্গে অনেকে গুলিয়ে ফেলে। এই শহরের মেয়রও কিন্তু একজন বাঙালি এবং আমাদের চট্টগ্রামের মানুষ। নাম মাহবুবুল আলম তৈয়ব।’ 

মিলবোর্নের ‘বাংলাদেশ অ্যাভিনিউ’-এ মাহবুবুল আলম তৈয়ব (বাঁ থেকে তৃতীয়)

বুঝলাম এটা আসলে বাংলাদেশি মেয়রেরই কাজ। মনে মনে ঠিক করলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করব। মাধবের বাসায় গিয়ে চা–নাশতা সারার পরপরই কথাটা পাড়লাম। তিনি বললেন, ‘দাদা আমি জানি আপনি তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাইবেন। এ জন্য তাঁকে এখানে আসতে বলেছি।’ 

মাধব জানালেন, পেনসিলভানিয়াএকটি শহর এই মিলবোর্ন। এই মিলবোর্ন ও আশপাশে প্রায় আট হাজার বাংলাদেশির বাস। মিলবোর্নের মেয়র ও পাঁচ কাউন্সিলম্যান বাংলাদেশি। বাঙালি প্রবাসীরা তাঁদের বাঙালি মেয়রের কাছে আবদার করেছেন একটি সড়কের নাম বাংলাদেশ রাখা হোক। কাউন্সিলম্যান এবং সংশ্লিষ্ট সবার সম্মতি নিয়েই সেটা বাস্তবায়ন করেছেন মেয়র। মিলবোর্নের মার্কেট স্ট্রিট ও সেলারস অ্যাভিনিউর সংযোগস্থল থেকে শুরু করে সেলারস অ্যাভিনিউ পুরোটার নামই ‘বাংলাদেশ অ্যাভিনিউ’ করা হয়েছে। 

আরও পড়ুন

মেয়রের সঙ্গে চট্টগ্রামি বোল

মাধবের বাসায় আড্ডার মধ্যেই মেয়র এসে হাজির। আগে–পিছে প্রটোকল, মানুষজন, গাড়ি, নিরাপত্তা–এসব কিছুই নেই। বসনভূষণ খুবই আটপৌরে, আচরণে বিনয়ী। খুব ক্যাজুয়ালি আমাদের সঙ্গে পরিচিত হলেন। মনে হলো অনেক দিনের চেনা। কথা বলেন নিচু স্বরে। কথা বলতে বলতে মনেই হলো না আমি যুক্তরাষ্ট্রের একটি সিটির মেয়রের সঙ্গে কথা বলছি, তা–ও আবার চট্টগ্রামের ভাষায়। কথায় কথায় শোনা হয়ে গেল তাঁর জীবনের গল্প।

মাহবুবুল আলম তৈয়ব জানালেন, চট্টগ্রামের দক্ষিণ মধ্যম হালিশহরে, পুরোনো ডাকঘরের কাছে তাঁর বাড়ি। বাবার নাম আবুল হোসেন। ২০০১ সালে আমেরিকায় পাড়ি জমান। প্রথমেই যান ফিলাডেলফিয়া শহরে। পেনসিলভানিয়ার অন্যতম বড় শহর ফিলাডেলফিয়া। ওখান থেকে একটু ভালো অবস্থানের জন্য চলে যান মিলবোর্ন। মিলবোর্ন পেনসিলভানিয়ার ডেলাওয়্যার কাউন্টির একটি শহর। মিলবোর্নে আসার পর থেকেই তিনি বিভিন্ন সামাজিক–রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত হন। স্থানীয় বাংলাদেশিদের সমর্থনে রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের সমর্থনের জোরে ২০১৫ সালে মিলবোর্ন সিটিতে ডেমোক্রেটিক পার্টি হয়ে কাউন্সিল নির্বাচন অংশ নিয়ে বিজয়ী হন। ২০১৯ সালে একই পদে আবার নির্বাচিত হন। এরপর ২০২১ সালে ডেমোক্রেটিক পার্টি হয়ে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন। ২০২২ সালে ৩ জানুয়ারি মেয়র হিসেবে শপথ নেন। 

মিলবোর্নে প্রবাসী বাংলাদেশিদের অনুষ্ঠান
ছবি: উইকিপিডিয়া

বিশাল এলাকা নিয়ে মিলবোর্ন। তবে জনসংখ্যা খুবই কম। ২০২০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ১ হাজার ২১২ জন। মেয়র জানালেন, এখানকার মোট জনসংখ্যার ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ বাংলাদেশি। তবে তাঁরা ছাড়াও সাদা-কালোনির্বিশেষে তাঁকে সমর্থন দিয়েছেন। 

তৈয়বের কাছে জানতে চাইলাম, আমেরিকার বুকে সড়কের নাম বাংলাদেশ রাখার চিন্তা কীভাবে এল? তিনি বললেন, ‘একদিন হয়তো আমি থাকব না, কিন্তু প্রথম বাংলাদেশি-আমেরিকান মেয়র হিসেবে এ শহরে যাতে পরবর্তী জেনারেশন আমাকে মনে রাখে এবং বাংলাদেশিদের নাম মনে রাখে তার জন্য এই উদ্যোগ। মূলত বাংলাদেশিদের স্বপ্ন পূরণ করতে এটি করা।’ 

মিলবোর্ন শহরের ঠিক মাঝখানে অবস্থিত এই সড়কের নাম আগে ছিল সেলারস অ্যাভিনিউ।  সেটিই এখন বাংলাদেশ অ্যাভিনিউ। ২০২৩ সালের প্রথম থেকেই নাম পরিবর্তনের কাজ শুরু করেন। সব কাজ নিয়মমতো সম্পন্ন করার পর ২০২৩ সালের ৩ ডিসেম্বর উদ্বোধন করা হয়। 

চট্টগ্রামের সন্তান মাহবুবুল আলম তৈয়ব
ছবি: সংগৃহীত

মেয়র হওয়ার পেছনে কার প্রেরণা বেশি ছিল জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, ‘আমার আগের মেয়র ছিলেন টমাস ক্রেমার। উনি সাদা আমেরিকান। আমি যখন দ্বিতীয়বারের মতো কাউন্সিল নির্বাচিত হই, তখন থেকেই আমাকে বলতেন উনার বয়স হয়ে গেছে, আর নির্বাচন করতে পারবেন না। উনি চাইতেন আমি নির্বাচন করি। সব সময় আমাকে প্রস্তুত থাকতে বলতেন। আমাকে তাঁর সব কাজে রাখতেন; যাতে আমি মেয়রের দায়িত্ব–কর্তব্য সম্পর্কে জানতে–বুঝতে পারি। একসময় যখন পার্টি থেকে মেয়রের জন্য প্রার্থী নির্বাচন করা শুরু করে, তখন তিনিই আমাকে অনুরোধ করেন। তিনি পার্টিকে জানিয়ে দেন যে তিনি আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না। তখন ডেমোক্রেটিক পার্টি আমাকেই নমিনেশন দেওয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করে। আমিও কাজ করা শুরু করি।’ 

২০২১ সালের প্রথম দিকে নমিনেশন কার্যক্রম সম্পন্ন হয়, তখন থেকেই তৈয়ব প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য প্রয়োজনীয় সব কাজ করতে শুরু করেন। পরিচিত বাংলাদেশি ভাইবোনদের সঙ্গে আলাপ শুরু করেন। বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। এই জনসংযোগেও মানুষের আন্তরিক সমর্থন পেয়েছেন তিনি। বাংলাদেশিরা তাঁদের কমিউনিটির একজনকে মেয়র হিসেবে দেখার স্বপ্ন বাস্তবায়নে একসঙ্গে কাজ করেন। সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলো এবং যুক্তরাষ্ট্রে একটা ইতিহাস তৈরি হলো—যুক্তরাষ্ট্রের একটি শহরের মেয়র হলেন একজন বাংলাদেশি।

তৈয়বের মেয়র হওয়ার এই সাফল্য কাহিনি শুনতে শুনতে বেলা অনেক গড়িয়ে গেল। কিন্তু মেয়র আমাদের ছাড়লেন না। বললেন, ‘দেশের মানুষকে পেয়েছি। বাসায় না নিয়ে ছাড়ব না। অগত্যা মেয়রের বাসভবনে গিয়ে নানা পদের বাঙালি আর আমেরিকান খাবারে আপ্যায়িত হলাম। সড়কে উৎকীর্ণ নামফলকের মতো এই দিনের কথা স্মৃতির ফলকে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।’