গ্রামের পিঠা যেভাবে শহুরে হয়ে উঠল
রাস্তা দিয়ে হাঁটলে ভাপা আর চিতই পিঠার সুঘ্রাণ একবার হলেও এখন নাকে এসে লাগবে। জেন-জি না হলে এই সুবাস আপনাকে ফিরিয়ে নেবে শৈশব আর কৈশোরে গ্রামে কাটানো দিনগুলোয়। অজস্র স্বাদু স্মৃতি আপনাকে মেদুর করে তুলবে। কারণও আছে ঢের। আমরা যাঁরা ওই প্রজন্মের, তাঁরা পিঠা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলে যেতে পারব। কিন্তু হালের ছেলেমেয়েরা তো আর সেসব দেখে বড় হচ্ছে না; বরং তাদের কাছে পিঠা একধরনের ফাস্ট ফুড। কারণ, এটা এখন দোকানে গিয়ে অনায়াসে কিনে আনা যায়। বাসায় বসে ফরমাশ দিয়েও বানিয়ে আনানো যায়। অথচ আমাদের কাছে পিঠা মানে ছিল একটা আয়োজন। পিঠা মানে উৎসব। পিঠা ঋতুর উদ্যাপন।
শীত মানেই পিঠার দিন
আমাদের সময় শীত মানেই পিঠার দিন। অগ্রহায়ণে শুরু হতো যার প্রস্তুতি, পৌষে গিয়ে হতো ইচ্ছাপূরণ। এরই মধ্যে কাটা হয়ে যাবে খেজুরগাছ। রস পাড়াও শুরু হবে। তৈরি হতে থাকবে গুড়। যে বাড়িতে গুড় তৈরি হবে, সেই বাড়ির আশপাশ গুড়ের গন্ধে ম–ম করবে। সময়মতো সেই নলেন গুড় (ঝোলা ও পাটালি) এনে তৈরি হবে পিঠা।
যে পিঠাই হোক, সেটা তৈরি হতে হবে সন্ধ্যার পর। দিনের সব কাজ সেরে, রাতের রান্না শেষ করে মাটির চুলায় কাঠের আগুনে তৈরি হবে পিঠা। তা সে ভাপাই হোক বা চিতই। চিতইয়ের আবার আছে নানা প্রস্তুতি। কারণ, ওই চিতই হবে মাটির খোলায়। সেখানে থাকবে চারটি করে ছাঁচ। প্রতিবার চারটি করে পিঠা হবে। এর মধ্যে যেগুলো ফুলবে না, সেগুলো খাওয়া হবে ঝোলা গুড় দিয়ে। চিতই যে নানা রকম ভর্তা দিয়ে খাওয়া যায়, সেই ডেলিকেসি তো শেখা হলো ঢাকায় এসে। প্রথম প্রথম কেমন যেন লাগত। মন মানতে পারত না। মনে হতো ‘গুরুচণ্ডালী’। আর যেগুলো ঠিকমতো ফুলবে, সেগুলো ফেলা হবে রসের মধ্যে। সেই রসেরও আছে নানা প্রস্তুতি।
গেরস্তের হেঁশেল থেকে তারকা হোটেল
ফুটপাত থেকে তারকা হোটেল—পিঠা আজ ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র। গ্রাম থেকে শহরমুখী হয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিবারগুলোও একান্নবর্তী থেকে নিউক্লিয়ার হয়েছে। ফলে পিঠার সংস্কৃতিও ক্রমে আগের অবস্থান হারাতে শুরু করেছে। গ্রামীণ পিঠা হয়ে উঠেছে শহুরে সংস্কৃতির অংশ। শহরে পিঠা জয়েন্টগুলোয় যেসব পিঠা তৈরি হয়, বিশেষত ভাপা আর চিতই, এগুলোর মান নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে, উপকরণের বিশুদ্ধতা নিয়েও কথা উঠতে পারে। কিন্তু তাতে তাদের বিক্রি তো থেমে নেই; বরং অনেক জায়গায় মানুষ লাইন দিয়ে কিনছেন।
পিঠার শহুরে হয়ে ওঠার পালায় নানা নিরীক্ষাও হচ্ছে। এসবও একেবারে ফেলনা নয়। এই যেমন ধরেন, খিলক্ষেতের কনকর্ড সিটির আশপাশে যে নারী ডিম পোচসহ চিতই বিক্রি করেন, তাঁর উদ্ভাবনকে কী বলবেন? এমন তো কত কিছুই হচ্ছে। ওই ডিম পোচ চিতই তো বেশ জনপ্রিয়। সকাল বা বিকেলের নাশতায় বেশ যায়। পুষ্টি ও স্বাদ উভয়ই নিশ্চিত হয়। কে না জানে চালের আটা গ্লুটেনমুক্ত; সঙ্গে ডিমের সংগত চিতইকে কেবল নতুন মাত্রাই দেয়নি, স্বাদেও এনেছে অভিনবত্ব। ওই ডিম পোচ পিঠার স্বাদ নিতে অনেকেই তাই ছুটছেন।
ছোটাছুটির কথা যখন এল, তখন বলতেই হয়, লম্বা ড্রাইভেরও উপলক্ষ হয়ে উঠছে এখন পিঠা। পিঠা খাওয়ার নাম করে দূরে কোথাও যেমন যাওয়া যায়, তেমনি এই অসিলায় একান্তে বেশ খানিকটা সময়ও কাটানো যায়। আসলে সবকিছু গুছিয়ে ছোট ফ্ল্যাটের সীমাবদ্ধ পরিসরে পিঠা বানানোর আয়োজন করাটা এখন কঠিন। ফলে সবাই ছোটেন দূরে কোথাও। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে ভালো গন্তব্য হতে পারে ৩০০ ফিট। নানা ধরনের পিঠা এখানে পাওয়া যায়। বিশেষ করে ছিটা পিঠার সঙ্গে হাঁসের মাংস। এই খাবার এখন চলতি ধারা। সবাই ছুটছে। ঐতিহ্যটা তো বেঁচে থাকছে। অন্যদিকে এসব যাঁরা বিক্রি করেন, তাঁদের সংসারও চলছে।
পিঠার বাণিজ্যিকীকরণ
স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে পিঠা বিক্রি শুরু করে গুলিস্তানের পিঠাঘর। একসময় এটা ছিল ঘড়ির দোকান। পরে এটাই বদলে হয় পিঠাঘর। ক্রমেই কবি, সাহিত্যিক ও গায়ক তথা সংস্কৃতিসেবীদের আড্ডাস্থল হয়ে ওঠে এই পিঠাঘর। পরে বেইলি রোড, উত্তরা, মিরপুর, খিলগাঁও ইত্যাদি নানা প্রান্তে ছড়িয়েছে পিঠা জয়েন্ট। নানা নামে, নানা মানুষের উদ্যোগে। তবে পথিকৃৎ হয়ে থেকে গেছে পিঠাঘর।
করপোরেট সংস্কৃতিতেও ঢুকে পড়েছে পিঠা। বিভিন্ন জাতীয় ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এই শীতে ক্লায়েন্টদের যেমন পিঠা উপহার পাঠাচ্ছে, তেমনি অফিসেও পিঠা উৎসবের আয়োজন করছে। মাদল খাবারঘরের অন্যতম কর্ণধার মেহেদি মাসুদ জানালেন, বিভিন্ন দূতাবাসও শীতে পিঠা উৎসবের আয়োজন করে থাকে। তারাও বাংলাদেশে পিঠা সংস্কৃতিকে সাদরে গ্রহণ করেছে। বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিও এই শীতে চিকিৎসকদের উপহার হিসেবে পিঠা পাঠাচ্ছে। আবার এ সময়ে গায়েহলুদেও আছে পিঠার চাহিদা। এ ক্ষেত্রে মাদল বিশেষ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। এ সময় পিঠার জন্য প্রতিদিন ১৫ থেকে ২০ জন কাজ করে বলে জানান মেহেদি মাসুদ। এই সংখ্যা কখনো কখনো ৭০ জনেও উন্নীত হয়।
করপোরেট সংস্কৃতিতে এই যে পিঠার জনপ্রিয় হয়ে ওঠা, তার নেপথ্যে কী আছে? এই প্রশ্নে মেহেদি মাসুদ যে জবাব দিলেন, তাঁর সঙ্গে আমিও একমত। বস্তুত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নীতিনির্ধারণী অবস্থানে এখনো যাঁরা আছেন, তাঁদের বলতে গেলে সবারই একটা সময় গ্রামে কেটেছে। নানি, দাদি, মা বা খালাদের হাতে তৈরি পিঠা খাওয়ার স্মৃতি আজও তাঁদের কাছে অমলিন। তাঁরা নস্টালজিয়ায় ভোগেন। এই নস্টালজিয়াই তাঁদের শিকড়ে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।