অলিম্পিকে বাংলাদেশের হয়ে তিনবার অংশ নিয়েছেন এই সাঁতারু, শুনিয়েছেন দারুণ কিছু অভিজ্ঞতা
একটি অলিম্পিকে অংশগ্রহণই বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের কাছে আজন্ম স্বপ্ন। তিন-তিনটি অলিম্পিকে যাওয়া তো দূর কল্পনা। কিন্তু কৃতী সাঁতারু ডলি আক্তারের কাছে তা ধরা দিয়েছে বাস্তব হয়ে। ২০০০ সিডনি, ২০০৪ এথেন্স আর ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে খেলার দুর্লভ অভিজ্ঞতা রাজবাড়ীর এই মেয়েকে দিয়েছে আজীবন গল্প করার উপলক্ষ। ডলি শুনিয়েছেন তাঁর দারুণ কিছু অলিম্পিক অভিজ্ঞতা। ২০১৬ সালের ১৩ আগস্ট ‘ছুটির দিনে’তে প্রকাশিত সেই লেখাটি পুনঃপ্রকাশ করা হলো। লিখেছেন মাসুদ আলম।
সিডনি হারবারে ‘মৌমাছি’
২০০০ সালে সিডনি অলিম্পিকের ফাঁকে বিখ্যাত হারবার ব্রিজ দেখাতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়দের। সেখানে ব্রিজের পাশে মৌমাছি সেজে ঘুরছিল একদল স্বেচ্ছাসেবী। ডলি একটু ইতস্তত, সামনে যেতে দ্বিধা। এ আবার কী! তাঁর সাহায্যে এগিয়ে এলেন সঙ্গী শুটার সাবরিনা সুলতানা, সাঁতারু কারার সামেদুল। ‘তাঁরা বললেন, এগুলো সত্যিকার মৌমাছি না রে। এত ভয় পাস কেন...।’ টুকরো এই স্মৃতিটা বলতে বলতে নিজেই হেসে ফেললেন ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১০ পর্যন্ত চারটি দক্ষিণ এশিয়ান গেমস খেলা ডলি। সাফ গেমসে গোটা পাঁচেক রুপার সঙ্গে ইন্দো-বাংলা গেমসে নয়টি সোনা জেতার পরিতৃপ্তি যাঁর সাঁতারজীবনকে দিয়েছে পূর্ণতা।
অলিম্পিকে শাড়ি
ডলি শাড়ি পরতে জানতেন না। কিন্তু শাড়ি না পরে তো উপায় নেই। গেমসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে লাল-সবুজ শাড়ি পরার রেওয়াজ আছে বাংলাদেশ দলের অ্যাথলেটদের। তাতে ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকে ডলিকে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেন আলেয়া ফেরদৌসি। একসময় টিভিতে নিয়মিত অভিনয় করা এই ক্রীড়া সংগঠকের সঙ্গে একই কক্ষে ছিলেন সিডনিতে। ‘আলেয়া আপা নিজে আমাকে শিখিয়ে দেন কীভাবে শাড়ি পরতে হয়।’ ডলির চোখমুখে কৃতজ্ঞতাও ফুটে ওঠে। বাংলাদেশের মেয়েদের এই শাড়ি পরাটা বিদেশি খেলোয়াড়দের চোখ টানে বরাবরই। এটা তুলে ধরে বাংলাদেশের নিজস্ব সংস্কৃতিও।
ঈদের জামা
প্রয়াত জাফর ইমামের কথা ভুলতে পারেন না ডলি। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক এই মহাসচিবের অনেক স্নেহ পেয়েছেন। ২০০৪ এথেন্স অলিম্পিকের পর এসে গেল ঈদ। আর সেই ঈদে ডলিকে উপহার কিনে দিলেন জাফর ইমাম। ‘উনি সেবার ঈদে আমাকে জামা কিনে দেন। কী যে খুশি হয়েছিলাম।’ ডলির চোখেমুখে আজও আনন্দ। পরক্ষণেই দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এর কিছুদিন পরই যে মারা গেলেন তাঁর প্রিয় ‘জাফর স্যার।’
বাবার জন্য হাতঘড়ি
তিনটি অলিম্পিকে গিয়েছেন, সেই সুযোগে টুকটাক কেনাকাটাও হয়েছে। বাড়ির সবার জন্য এটা-ওটা এনেছেন। তবে সব ছাপিয়ে একটি উপহারের কথা ডলির মনে পড়ে আলাদা করে। অস্ট্রেলিয়া থেকে বাবা রওশন আলীর জন্য সোনালি রঙের একটা ঘড়ি এনেছিলেন; যা এখনো আছে। বিশেষ উপহার বলে কথা!
দাদির স্মৃতি
স্কুলে সেই ছোট্টটি থাকার সময় থেকেই সাঁতারের সঙ্গে মিতালি। স্কুল ছুটির পর বাড়ি না গিয়ে ছোট্ট মেয়েটি ছুটত পুকুরে। রাজবাড়ী শহীদ স্মৃতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশেই স্থানীয় জেলা স্টেডিয়াম, আর সেটির কোলঘেঁষেই ‘স্টেডিয়াম পুকুর’ হয়ে উঠল মেয়েটির ঠিকানা। বাড়ি থেকে চুপিচুপি গামছা আর সুইমিং পোশাক ব্যাগে ভরে নিয়ে যেতেন নিয়মিত। এ কাজে সহায়তার হাত বাড়ান দাদি আনিছা খাতুন। ডলি বলেন, ‘দাদিই সবচেয়ে বেশি সহায়তা করত সাঁতারের ব্যাপারে। প্রতিবার অলিিম্পক থেকে ফিরে দাদির সঙ্গে কত যে গল্প!’ গত ফেব্রুয়ারিতে পরপারে পাড়ি জমানো দাদির প্রতি ডলি জানান গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসাও।
সেই দুঃস্মৃতি
ভালো ভালো স্মৃতির সাগরে দু-একটি দুঃস্মৃতি না থাকলে কী চলে! বিধাতাও বুঝি এটা চাইছিলেন। তাই অলিম্পিকে প্রথমবার (২০০০ সিডনি) গিয়েই ভিন্ন অভিজ্ঞতা হলো। বয়স তখন মাত্র ১৩-১৪। প্রতিযোগিতার সময় গ্যালারি থেকে বাঁশির আওয়াজ পেয়ে পুলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ব্রেস্টস্ট্রোক ইভেন্টে। ডিসকোলিফাইড হওয়ার সেই হতাশা আর অনেকের টিপ্পনী মিলে জেদ তৈরি হলো মনে। যাঁর হাত ধরে বেড়ে উঠেছেন, রাজবাড়ীর সেই কোচ শহিদুন্নবী আলমের পরামর্শ শুনলেন...‘আরও পরিশ্রম করতে হবে বেটি।’ ২০০৮ বেইজিংয়ে ৫০ মিটার ফ্রিস্টাইলে নিজের হিটে প্রথম হয়ে সেই ডলি দেখিয়ে দিলেন, কষ্ট করলে কেষ্ট মেলে। আজ তৃপ্ত মনে স্মরণ করেন তাঁর সেই নিবেদিতপ্রাণ কোচকে, যিনি এখন অসুস্থ। তুলে আনেন সেবার সতীর্থ সাঁতারু কারার সামেদুলের কথাও। ডলিকে সামেদুল বলেছিলেন, ‘কী রে, তুই বুঝি বুঝতে পারসনি...কীভাবে ডিসকোয়ালিফাইড হইলি।’
মহাপ্রাচীরে একদিন
বেইজিং গেমসের ফাঁকে মহাপ্রাচীর দেখাতে নেওয়া হয় তাঁদের। সঙ্গী অ্যাথলেট নাজমুন নাহার, শুটার ইমাম হোসেন, সাঁতারু জুয়েলরা। গিয়ে দেখলেন লম্বা লাইন। ‘উঁচুতে উঠতে উঠতে আমরা ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিলাম।’ ডলির কাছে ওটা ছিল রোমাঞ্চকর সময়।
এবং ফেল্প্স-দর্শন
মাইকেল ফেল্প্সের সঙ্গে কথা বলা বা ছবি তোলার ইচ্ছেটা কার না হবে! ডলিরও হয়েছিল এবং বেইজিংয়ে তা পূরণ করেন। ওয়ার্মআপের সময় ছবি তুললেন, পরিচিত হলেন। একই সাঁতার কমপ্লেক্সে কাছাকাছি দূরত্বে ফেল্প্স আর তাঁর নিজের অনুশীলন করার ক্ষণটা ছিল দারুণ উপভোগ্য। সব নাকি স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছিল। ‘আমি ব্রেস্টস্ট্রোক করছিলাম, পাশে ফেল্প্সকে দেখলাম বাটারফ্লাই করছেন।’ ডলির অলিম্পিক স্মৃতিতে বড় জায়গাজুড়ে আছেন এবারের রিও গেমসেও ঝড় তোলা সর্বকালের সেরা সাঁতারু। আর ডলি নিজে থাকবেন বাংলাদেশের অলিম্পিক ইতিহাসের বলার মতো একটা অংশজুড়ে। যেখানে পদক জেতা নয়, অংশগ্রহণের আনন্দই লেগে থাকে সবার চোখেমুখে।