চামড়া দিয়ে নিজেই বানাই জুতা, জ্যাকেট, ব্যাগ
‘ল্যাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরিশ্রম করলে একসময় বিরক্তি লাগতে শুরু করে। কিন্তু নিজ হাতে তৈরি জুতাটা দেখে সব কষ্ট ভুলে গেছি। চামড়ার ফটোফ্রেম তৈরি করে মামণি আর ওয়ালেট বানিয়ে বাবাকে উপহার দিয়েছিলাম। মেয়ের হাতে বানানো জিনিস পেয়ে তো তাঁরা ভীষণ খুশি’, বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির শিক্ষার্থী পারিজাত চন্দ্রননা।
চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ থেকে শুরু করে পণ্য তৈরি—পুরোটাই এই ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীদের পড়ালেখার অংশ। এই পুরো কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার অভিজ্ঞতা আদতে কেমন? জানতে ২০ সেপ্টেম্বর আমরা হাজির হয়েছিলাম ঢাকার হাজারীবাগে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির ক্যাম্পাসে। তিনটি বিভাগে এখানে পড়ালেখা করানো হয়—লেদার প্রোডাক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং, ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এবং লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং।
প্রক্রিয়াজাত চামড়া তৈরির যজ্ঞ
ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির ক্যাম্পাস আলো করে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিন্নীগাছ। শতবর্ষী গাছটা যে শুধু শিক্ষার্থীদের প্রশান্তি দেয়, তা-ই নয়, এর বাকলের নির্যাস দিয়ে চামড়াও ট্যানিং করা যায়। বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে পচনশীল কাঁচা চামড়াকে ব্যবহার উপযোগী চামড়ায় পরিণত করার পদ্ধতি হলো ট্যানিং।
ইনস্টিটিউটের লেদার ল্যাবরেটরিতে ঢুকলে দেখা যায়, বিশাল সব স্টিলের ড্রাম, সারি সারি সাজানো ট্যানিংয়ের প্রয়োজনীয় রাসায়নিক দ্রব্য। ব্যবহারিকের কাজে ব্যস্ত দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী অর্পিতা রায় বলেন, ‘লেদার ল্যাবে সবাই একসঙ্গে কাজ করতে মজা লাগে। কিন্তু অন্য সেমিস্টারের ল্যাব ফাইনাল পরীক্ষা থাকলে মাঝেমধ্যে ড্রাম স্বল্পতার কারণে কাজ করতে অসুবিধায় পড়তে হয়।’
জানা গেল, লেদার প্রকৌশল বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মাশরাফি বিন ইমরান কাঁচা চামড়া ট্যানিং করে ভিন্ন একধরনের ব্যবহারযোগ্য চামড়া তৈরি করেছেন, যা অন্ধকারে আলো বিকিরিত করে। ট্যানিংয়ের সময় তিনি বিশেষ রাসায়নিক আলোক বিকিরক রঞ্জক ব্যবহার করেছেন। তাঁর এই প্রকল্প ক্যাম্পাসে বিশেষ সম্মাননাও পেয়েছে।
জুতা তৈরির যত কৌশল
নকশি পিঠা বানাতে যেমন ছাঁচ লাগে, তেমনি চামড়া, প্লাস্টিক বা স্টিলের জুতারও ছাঁচ আছে। যাকে বলে লাস্ট। সব ধরনের জুতারই আছে আলাদা মডেলের লাস্ট। পিঠা তৈরির উপকরণ, যেমন চিনি, ময়দা, তেল, ঘি; জুতার জন্য তেমনি ইনসোল বোর্ড, ইনসক, মিডসোল, আউটসোল, টো পাফ, কোয়ার্টার পার্ট ইত্যাদি। সব অংশের সরঞ্জাম প্রথমে প্যাটার্নের সাহায্যে সঠিক মাপে কেটে নেওয়া হয়, পরে একেকটি অংশ মিলিয়ে তৈরি হয় জুতা। পুরো কাজটিই বেশ কঠিন ও সময়সাপেক্ষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ল্যাবে দাঁড়িয়ে থেকে শিক্ষার্থীরা এসব কাজ করেন।
ফুটওয়্যার প্রকৌশল বিভাগের প্রভাষক রায়হান সরকার বলেন, ‘তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক ক্লাসে পড়ানোর পর শিক্ষার্থীরা যখন কোনো মানসম্মত পণ্য তৈরি করে, শিক্ষক হিসেবে নিজেকে সফল মনে হয়।’ শুধু জুতা নয়, কীভাবে চামড়াজাত অন্যান্য পণ্য বানাতে হয়, সেসবও শেখেন শিক্ষার্থীরা। যেমন মানিব্যাগ, ব্যাগপ্যাক, ফ্যাশনেবল নকশার ব্যাগ, লেদারের জ্যাকেট, স্কার্ট, ওয়েস্টকোট ইত্যাদি।
স্নাতক শেষে আমাদের শিক্ষার্থীরা কেউ বেকার বসে থাকছে না। আগের তুলনায় এখন তাঁরা চামড়া খাতে চাকরির ব্যাপারে অনেক আগ্রহী। আমার বিশ্বাস, আমার ছাত্রছাত্রীরা গবেষণার কাজে ভবিষ্যতে আরও ভালো করবে, চামড়াশিল্পের উন্নয়নে নতুন মাত্রা যোগ করবে।মোহাম্মদ মিজানুর রহমান, পরিচালক, লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি ইনস্টিটিউট
পড়া শেষে উদ্যোক্তা
সদ্য স্নাতক শেষ করা তরুণ উদ্যোক্তা যুগল নুঝাত তাবাসসুম ও মুবতাসিম হোসেন চৌধুরী (ডাকনাম নীর)। দুজনই লেদার প্রোডাক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী। ২০২২ সালের মার্চে তাঁরা হাতে বানানো চামড়াজাত পণ্যের প্রচারণার জন্য একটি অনলাইন পেজ খোলেন। নাম এন্যানেন লেদার ক্রাফট। এই অদ্ভুত নামের মানে কী? নুঝাত বুঝিয়ে বলেন, ‘আমাদের দুজনের নামের আদ্যক্ষর মিলিয়ে এন অ্যান্ড এন—সংক্ষেপে এন্যানেন।’
করোনার সময় অলস সময় কাটছিল। সে সময় হাজারীবাগের দোকান থেকে পছন্দসই লেদার কিনে এনে একটি কার্ডহোল্ডার তৈরি করেন তাঁরা। মুবতাসিম বলেন, ‘কার্ডহোল্ডারটা আমি নিজের জন্যই বানিয়েছিলাম। আমার কাজিন দেখে খুব পছন্দ করল। ওর জন্যও একটা বানিয়ে দিতে বলল। এটাই ছিল আমাদের প্রথম অর্ডার।’ শুরুতে হ্যান্ড স্টিচিং করতে অনেক খাটুনি হতো। সেলাই আঁকাবাঁকা হয়ে যেত। দেখা যেত, এক হ্যান্ডব্যাগই বানাতে হচ্ছে একাধিকবার। এসব বাধা পেরিয়েই এখন পর্যন্ত ৫০টির বেশি পণ্য বানিয়ে বিক্রি করেছেন তাঁরা।
সৃজনশীল চামড়াপণ্য
চামড়ার বর্জ্য পুনর্ব্যবহার করে কীভাবে সৃজনশীল নতুন পণ্য তৈরি করা যায়, তা নিয়েও কাজ করছে চতুর্থ বর্ষের একদল শিক্ষার্থী। লেদারের সামগ্রী বানানোর পর উচ্ছিষ্ট ছোট ছোট টুকরা ফেলে না দিয়ে পুনর্ব্যবহার করে কেউ বানিয়েছেন ফ্যাশনেবল হ্যান্ডব্যাগ, শোপিস, জাতীয় কবির প্রতিকৃতি, সোলার প্যানেলযুক্ত ব্যাগপ্যাক ইত্যাদি। চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী কাওসার আহমেদ বলেন, ‘প্রজেক্ট ওয়ার্কে সহপাঠীরা যখন লেদার কাটিং ওয়েস্টেজ থেকে ব্যাগপ্যাক, জুতা বানাচ্ছে, তখন আমি চিন্তা করি আলাদা কী করতে পারি? তখন চামড়া দিয়ে ময়ূর তৈরির কথা মাথায় আসে।’ আরেক শিক্ষার্থী কাজী নুসরাত জাহান শুরুতে লেদারের স্কার্ট বানিয়েছেন। অবশিষ্ট কাটিং ওয়েস্ট কাজে লাগিয়ে তৈরি করেছেন কাজী নজরুল ইসলামের প্রতিকৃতি। নাদিয়া ফেরদৌস বানিয়েছেন ব্যাগপ্যাক, যেটা উল্টো-সোজা—দুভাবেই ব্যবহার করা যায়। ব্যাগটিতে তিনি যুক্ত করেছেন সোলার প্যানেল। জরুরি অবস্থায় এই সোলার প্যানেলে ফোন চার্জ করা যাবে। নাদিয়া বলেন, ‘যদিও সোলার প্যানেলের কার্যক্ষমতা শতভাগ নিশ্চিত করতে পারিনি, তবে কষ্টটা একেবারে বিফলেও যায়নি। এখন ১ শতাংশ চার্জ হতে প্রায় ২০ মিনিট সময় লেগে যাচ্ছে।’